শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০১:৩৬ পূর্বাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
‘আরা যদি দেশত ফিরি যাইন ন ফারি আহারা মরি যামু। আরা এ দেশত ন থাকতি চাই। আরা আর বালা লাহে না। নিজ দেশে মরি গিয়ে ভালো’ কথাগুলো বলছিলেন উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৭ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা আবদুর রহমান। তার সঙ্গে সুর মেলান অন্তত শতাধিক রোহিঙ্গা। নিজ দেশে ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন তাদের মতো অন্য রোহিঙ্গরাও। তবে রোহিঙ্গাদের ভেতরে থাকা কিছু চক্র বাধা দিচ্ছে, যাতে তারা নিজ দেশে যেতে না পারেন। ওই চক্রগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের কয়েকটি চক্র। দুপক্ষের এসব চক্র রোহিঙ্গাদের ঘিরে নানাভাবে লাভবান হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকেই প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে তারা ইয়াবার চালান আনছে নিয়মিত। মাদক কারবারিদের পাশাপাশি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার সদস্যদের তৎপরতা রয়েছে। মিয়ানমার থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে সাধারণ রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছেন। তাছাড়া বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মকা- নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আর এসবের কারণে ওইসব এনজিওর কর্মকা- নজরদারি করছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচিত হন। বিশ্বনেতারা সরকারপ্রধানের প্রশংসা করে বিবৃতি দেন। রোহিঙ্গাদের দেখতে বিশ্বনেতারা বাংলাদেশ সফর করেন। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরগুলোতে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের ভালো পরিবেশে রাখতে নোয়াখালীর ভাসানচরে একটি আবাসন পল্লীও গড়ে তোলে সরকার। সেখানে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তারপরও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে ব্যাকুল। এমনকি তাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহল চাপ দিচ্ছে মিয়ানমারকে। গত বুধবার মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ের জন্য টেকনাফে এসেছে। ওইদিনই সেখানে একজন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। গতকাল আরেক রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিনে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জুলেখা বিবি, আবিদুর রহিম, জুলহাস মিয়াসহ শতাধিক রোহিঙ্গা দেশ রূপান্তরকে জানান, তারা মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চান। স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চান সেখানে গিয়ে। জান্তা সরকার তাদের মেরে ফেললেও দেশেই মরতে চান তারা। আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তারা জানান, যদি দেশে ফিরতে না পারেন তাহলে আত্মাহুতি দেবেন।
ক্যাম্পের লোকজন আরও জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক কারবারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা- চলে আসছে। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে তাদের বসবাস। ক্যাম্পের ভেতরেই গড়ে উঠেছে একাধিক মাদক চক্র। এ ছাড়া খুন, ডাকাতি ও অপহরণকারী একাধিক চক্রও সেখানে ত্রাস ছড়াচ্ছে। কুতুপালংসহ কয়েকটি ক্যাম্পে অপরাধীদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব অপরাধী নিজেদের মধ্যে প্রায়ই মারামারি, খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে। এসব চক্রের মধ্যে মাস্টার রফিক, মৌলবি ইউনুছ, আনাস, আরসা ও মুন্না গ্রুপের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে।
তারা জানান, আরসাও চাচ্ছে রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমার না যেতে পারে। পাশাপাশি কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ার কিছু চক্রও চেষ্টা চালাচ্ছে তারা যেন নিজ দেশে ফেরত না যেতে পারে। তারা রোহিঙ্গাদের নানাভাবে বোঝাচ্ছে যে, মিয়ানমার সরকার আগের মতো দমনপীড়ন চালাবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক মহলকে অনুরোধও করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালায়। আরসার বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। রোহিঙ্গাদের একটি চক্র অপহরণসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি।’
জানা গেছে, টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে দেশি-বিদেশি অর্ধশত এনজিও কাজ করছে। রোহিঙ্গা শিশুদের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি এনজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে কয়েকজন রোহিঙ্গা। তারা নাম প্রকাশ না করে বলে, আরসা, স্থানীয় কিছু চক্র ও কয়েকটি এনজিও চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফেরত যাক। কারণ তারা চলে গেলে এনজিওগুলো সমস্যায় পড়বে।
রোহিঙ্গারা বলছে, তারা দেশে ফিরতে মরিয়া। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলকে জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া, সবাইকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া, মিয়ানমারের অন্য নাগরিকরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায় ওই ধরনের সুবিধা দেওয়া, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তাদের সহায়-সম্পদ ফেরত দেওয়া, গৃহপালিত পশুগুলো ফেরত দেওয়া, সবুজ রঙে পরিচয়পত্র ফেরত ও নতুন করে কার্ড তৈরি করে বসবাস করার সুযোগ দেওয়া এ বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মহলকে নজরে রাখতে অনুরোধ জানায় রোহিঙ্গারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাম্পের ভেতরে হত্যাকা-সহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। এই নিয়ে মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে একাধিক বৈঠক হয়েছে। তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠতে সরকার নানাভাবে কাজ করছে। তাছাড়া রোহিঙ্গারাও দেশে ফেরত যেতে চাচ্ছে। কয়েকটি এনজিওর বিষয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে।’
ভয়েস/আআ/দেশ রূপান্তর