বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৭:২৯ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আরাভ–কাণ্ড থেকে সাকিব কি শিক্ষা নেবেন

আনিসুল হক:

কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ! সাকিব আল হাসান যাচ্ছেন দুবাইতে। তিনি ভিডিও বার্তা দিলেন: ‘আমি সাকিব আল হাসান আসছি ১৫ মার্চ। আরাভ জুয়েলারি শপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। আপনি আসছেন তো!’ সেই ভিডিওর নিচে কমেন্ট আছে, ‘হিরো আলম তো আপনার আগেই দাওয়াত দিয়েছেন।’ আরও আরও তারকারা যাচ্ছেন সেই আরাভ জুয়েলারিতে।

ঠিক তার আগে আগে চাউর হয়ে গেল, এই আরাভ খান যেনতেন কেউ নন, তিনি পুলিশ খুনের আসামি। সাকিব আল হাসানকে জানানো হয়েছে, তিনি যেন ‘পুলিশ-হন্তারক’ আরাভ খান ওরফে রবিউল আলম ওরফে এক্স ওয়াই জেডের এই দাওয়াতে অংশগ্রহণ না করেন। কিন্তু ততক্ষণে পালে হাওয়া লাগিয়াছে। দুবাইগামী বিমানের আরোহীদের মনে তত্ত্বের উদয় হইল, ‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’

সাকিব ক্রিকেটের বড় প্রতিভা। আর তাঁর স্নায়ু-শক্তি অসম্ভব পর্যায়ের। আমরা যদি খেয়াল করি, ইংল্যান্ডের ওডিআই বিশ্বকাপে সাকিব যখন সেঞ্চুরি করতে শুরু করলেন, মনে হলো যে তিনি ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হয়ে যেতে পারেন, তখন আসলে তাঁর বিরুদ্ধে বাজিকরের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন ধরে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে এবং সেটা তিনি জানেন। সেটা জানা সত্ত্বেও বল আর ব্যাট হাতে তিনি সাংঘাতিক ভূমিকা দেখিয়ে যেতে লাগলেন। এবারও দুবাই থেকে সারা রাত উড়াল শেষে ঢাকায় নেমে রাতে তিনি গেলেন একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। পরের দিন গেলেন সিলেটে। তারপরের দিন খেলতে নেমে তিনি ব্যাট হাতে ৯০ পার করে ফেললেন! এই মানুষটা কোন ধাতুতে গড়া!

সাকিব পারেন বলেই সাকিবকে আমরা ভালোবাসি, আর সে কারণেই তাঁকে নিয়ে সদা শঙ্কিত মা-বাবার মতো উদ্বিগ্ন থাকি! চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলা চলাকালেই কেন তাঁকে দোকান উদ্বোধন করতে যেতে হবে? ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ড সিরিজের মধ্যভাগে দুদিনের অবসরেই কেন দুবাই যেতে হবে? আরাভ খান খুনি কি খুনি না, সেটা বড় প্রশ্ন, কিন্তু খেলার আগে আমাদের খেলোয়াড়েরা শুধু খেলাকেই ধ্যানজ্ঞান করে তুলবেন, আমরা তো তা-ই চাই। আর সাকিব আমাদের আইডল, শিশু-কিশোরদের সামনে আমরা সাকিবের গল্প বলি! সেই সাকিবই টিভি ক্যামেরার সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে শাস্তি পান, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ চালাচালি করে নিষিদ্ধ হন, টুপি দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল ভক্তকে বাড়ি মেরে আলোচিত হন এবং আরাভ খান বিতর্কে পড়েন।

সাকিবকে বলব, আর দুটো বছর শুধু ক্রিকেটেই ধ্যানস্থ হন। বছর শেষের ওডিআই বিশ্বকাপটাতে চোখ রাখুন। দৃষ্টি স্থির করুন তারপরের বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। গুরু দ্রোণ তির-ধনুকের প্রশিক্ষণে শিষ্যদের পাখি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা কে কী দেখতে পাচ্ছে। পাণ্ডব কৌরবরা কেউ আকাশ, কেউ গাছ, কেউ পাখির কথা বলেছিল। ‘অর্জুন, তুমি কী দেখতে পাচ্ছ?’ ‘আমি দেখতে পাচ্ছি পাখির চোখ’—অর্জুন উত্তর দিয়েছিলেন। সাকিব এত কিছু করে, এত বিতর্কে জড়িয়েও মাঠে নিজেকে প্রমাণ করতে জানেন বলেই সাকিবকে আমরা বলব, আপনি ক্রিকেটকে পাখির চোখ করে তুলুন। আর সবকিছু ভুলে যান। আর দুটো বছর। ব্যবসা, টাকাপয়সা, বিজ্ঞাপন সারাটা জীবন করতে পারবেন। এক হাজার কোটি টাকার মালিক পৃথিবীতে অনেক আছে, কিন্তু সাকিব আল হাসান আছে মাত্র একজন। বিশ্বের এক নম্বর। এমনকি আপনি শুধু দেশের নন, আপনি পৃথিবীর। এই প্রতিভাকে অবহেলা করবেন না। আমি জানি, আপনি উপদেশ পছন্দ করেন না। কিন্তু আমরা আপনাকে ভালোবাসি, আর ভালোবাসা মানেই এখতিয়ার-বহির্ভূতের অত্যাচার। একটু সহ্য করুন। আমাদের প্রত্যাশাকে চাপ হিসেবে না দেখে প্রেরণা হিসেবে নিন।

এখন আসি হিরো আলমের তোলা প্রশ্নটিতে। কথা সত্য। ‘আমরা দুবাই যাওয়ার আগে ডিবি বা পুলিশ বা গণমাধ্যমে কোনো কথা বলল না কেন?’ এত দিন কোথায় ছিলেন? পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খুন হন ২০১৮ সালে। বনানীর একটা বাড়িতে। তাঁর লাশ গাজীপুরের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। মামলা করেন নিহত মামুনের ভাই। পুলিশ পরের বছর ১০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়।

প্রশ্নটা হলো, এত দিন এই খবর কোথায় ছিল! খুনের আগে-পরে কতগুলো ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে বলে এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে! যেমন: ১. রবিউল ইসলাম যৌন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁকে সহযোগিতা করতেন স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার ওরফে কেয়া। মামুন রাজধানীর বনানীর যে ফ্ল্যাটে খুন হন, সেখানেই রবিউল তাঁর সহযোগীদের দিয়ে যৌন ব্যবসা চালাতেন। ২. রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। একজন নেতা এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তার সুপারিশে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়! ৩. হত্যা মামলার আসামি রবিউল ওরফে আরাভ খানের পরিচয় ধারণ করে কারাগারে ঢুকেছিলেন চাঁদপুরের যুবক আবু ইউসুফ ওরফে লিমন। প্রায় ৯ মাস জেল খেটে প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে তিনি কারামুক্ত হন। ৪. রবিউল ভারতে যান। ভুয়া পরিচয়ে পাসপোর্ট নিয়ে তিনি এখন ব্যবসা করছেন, মুক্ত বিহঙ্গের মতো চলাচল করছেন। ৫. গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকার পরও গত বছরের মার্চ এবং সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। দুবাইয়ে বাংলাদেশ শিল্পী সমিতির অনুষ্ঠানে পৃষ্টপোষক হিসেবে ভারতীয় পাসপোর্টধারী আরাভ খান বাংলাদেশের কনসাল জেনারেলের হাত থেকে ক্রেস্টও গ্রহণ করেন।

এত কিছু ঘটছে, ডিবি পুলিশ কোনো টুঁ শব্দটি করল না, যে-ই না সাকিবরা তাঁর শোরুম উদ্বোধনে যাওয়ার জন্য বেরোলেন, অমনি রাতারাতি আরাভ খান রবিউল হয়ে গেলেন! এতদিন কেন আইন শৃঙ্খলা–রক্ষাকারী বাহিনী মুখে কুলুপ এঁটে ছিল?

আরাভ খানের এই খবর আমাদের ভয়াবহ কতগুলো বার্তা দেয়। এক. দেশে রাতের রাজারা দিনের রাজা হয়ে উঠেছেন। আন্ডারওয়ার্ল্ড আর ভূগর্ভে নেই, তারা মাটির ওপরে উঠে এসেছে এবং তাঁদেরই আমরা ফুলের মালা পরাচ্ছি। এই বার্তা আমরা ক্যাসিনো-কাণ্ডের সময়, পাপিয়া-কাণ্ডের সময়ও দেখেছি। মাদক, যৌন ব্যবসা, অস্ত্র, চোরাচালান, রাজনৈতিক প্রভাবশালী, প্রশাসনিক প্রভাবশালী, আইন রক্ষাকারীদের মধ্য থেকে একজন-দুজন প্রভাবশালী, দুর্বৃত্ত, কালোটাকার মালিক, ক্যাসিনো, জুয়া ইত্যাদি মিলে নরক গুলজার হয়ে আছে। এই সোনার বাংলাদেশে এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? আমরা ছিলাম কোথায়, আছি কোথায়, ডুবে যাচ্ছি কোন অন্ধকার অতলে? মনে হচ্ছে, আরাভ খান হিমবাহের ওপরের অংশমাত্র। ১০ ভাগের ৯ ভাগই আছে পানির নিচে।

নেটফ্লিক্সে একটা প্রামাণ্য ছবি আছে। দ্য টিন্ডার সুইন্ডলার। ইসরায়েলে জন্ম নেওয়া শাইমন হায়াত ছিলেন সাধারণ যুবক, যিনি কাজ খুঁজছেন। প্রতারণা মামলার আসামি। তিনি নিজেকে বিলিয়নিয়ার হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিজের ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট তৈরি করেন। তারপর প্রেম করা শুরু করেন বড়লোক মেয়েদের সঙ্গে। মেয়েদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তিনি আবার অন্য মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামি হোটেলে। চড়ে বেড়াতেন দামি বিমানে। একটা প্রতারণার টাকা দিয়ে প্রতারিত করতেন অন্য মেয়েদের।

আরাভ খান তাঁকেও হার মানিয়েছেন। হার মানিয়েছেন আয়নাবাজি সিনেমার ঘটনাকেও। কিন্তু কোনো মুরব্বি ছাড়া একাই কি তাঁর এই বিশাল উত্থান? তাঁর মাথার ওপরে ছায়া দিয়েছেন কারা?

আমরা শুনি, দুবাই বাংলাদেশের ডলার পাচারের একটা গন্তব্য। সাকিব কেন দুবাইতে, এই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোচ্ছে, কিন্তু কেউটে খুঁড়তে গিয়ে কটা অ্যানাকোন্ডা বেরিয়ে আসে, সেইটাই প্রশ্ন। এবং সেখানেই ভয়। অ্যানাকোন্ডারা কি নিজেদের পরিচয় প্রকাশিত হতে দেবে?

আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক

ভয়েস/জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION