শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:৫৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বৈষম্য যখন মূলে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

একটা সময় ছিল বাংলাদেশের মানুষ কলকাতার মানুষের মাছ মাংস ক্রয় নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতো। তারা টুকরা মাছ বা মাংস ক্রয় করতো পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিচারে। সেটা কিছুটা ছিল তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এবং অবশ্যই অনেকটাই ছিল মিতব্যয়িতার চর্চা।

আজ বাংলাদেশে সেই বাস্তবতা উপস্থিত। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় দেশের মানুষের বড় একটি অংশেরই একসাথে এক কেজি মাংস কেনা সম্ভব না। সেই বাস্তবতা বুঝতে পেরে সুপার শপগুলো ‘কেজি নয়, গ্রাম হিসেবে’ মাংস বিক্রি শুরু করেছে। ভাগে নাকি মুরগিও বিক্রি হচ্ছে নানা জায়গায়। আর খাসির মাংস তো একেবারেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

অনেক বছর ধরেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের বড় গল্প আমরা শুনে আসছিলাম। করোনা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে সেটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড, মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি সবকিছু নিয়েই জনমনে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।

কিছু মানুষের কী বড় আয় বন্ধ রয়েছে? কিছু মানুষের কী দেশে ও দেশের বাইরে আগের মতোই বিলাসী জীবনে কোনো ঘাটতি পড়েছে? নিশ্চয়ই না।

আমরা জানি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কাঠামোর অভ্যন্তরে থাকা গোষ্ঠী খুব দ্রুত ধনী হচ্ছিল বাংলাদেশে এবং এখনো হচ্ছে। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, কিছু মানুষের আয় বেশি করে বাড়ার অর্থই হলো অনেক মানুষের আয় কমে যাওয়া। সেটাই ঘটছে বাংলাদেশে।

ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতায়নের উদাহরণ এখন অসংখ্য। এদের হাতে যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তা-ই সত্য। নয়তো জেলা শহর ফরিদপুরের দুই ছাত্রলীগ নেতা কী করে দুই হাজার কোটি টাকা পাচার করতে পারে?

অবকাঠামোগত উন্নয়ন অর্থাৎ পথ-ঘাট, সেতু, স্থাপনা সবই আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু শাসন ব্যবস্থা যদি মানুষের জন্য উন্নয়নের কথা না ভাবে তবে বৈষম্য বাড়া ছাড়া কাঠামোগত উন্নয়ন হৃদয় ছুঁতে পারে না।

মানব উন্নয়নে সামগ্রিক বৈষম্যের সঙ্গে আর্থিক বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে প্রতিবন্ধকতার কী কার্যকারণ সম্পর্ক, তা নিয়ে আরও ভাবনা প্রয়োজন। কিন্তু সম্পর্ক যে রয়েছে, সেই কথা অনস্বীকার্য।

আর্থিক বৈষম্য একুশ শতকে বিশ্ব উষ্ণায়নের মতোই একটি ঘোরতর সমস্যা, কিন্তু সেই কথা আমাদের শাসন প্রণালীতে কমই আলোচিত হয়।

অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ক্ষমতাই হলো মূল কথা। যার ক্ষমতা আছে তিনি তেমন কিছু না করেও কমিশন চর্চা করে বড় আয়ের মালিক হতে পারেন। যারা কিছু করেন অর্থাৎ ব্যবসা, চাকরি, রাজনীতি তারা আবার ক্ষমতার যথেচ্ছাচার প্রয়োগ করে সব দখলে রাখতে পারেন।

এমন ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতায়নের উদাহরণ এখন অসংখ্য। এদের হাতে যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তা-ই সত্য। নয়তো জেলা শহর ফরিদপুরের দুই ছাত্রলীগ নেতা কী করে দুই হাজার কোটি টাকা পাচার করতে পারে?

আমাদের সংবিধানে যে ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য কথাগুলো আছে এসবের কোনো অর্থ আর মানুষের কাছে নেই। আছে কেবল বেঁচে থাকার লড়াই। এর বড় কারণ হলো বড় বড় প্রকল্প রূপায়নের পাশাপাশি সুশাসনের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়েছে শাসন ব্যবস্থা থেকে।

সর্বত্রই নৈরাজ্য, পেশি প্রদর্শন, দখল, হুমকি, হয়রানি এবং ক্ষমতাহীন মানুষের ওপর ক্ষমতাবানদের বল প্রয়োগ। সেটা ছাত্র রাজনীতি হোক বা পাড়ার রাজনীতি হোক, জেলার রাজনীতি হোক বা কেন্দ্রের রাজনীতি হোক। পুলিশ আর প্রশাসনের হাতেও ক্ষমতা প্রয়োগের অবাধ স্বাধীনতা।

অতিরিক্ত ক্ষমতা, সুযোগ এবং জবাবদিহিতার অভাব বড় আকারে দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করেছে। দুর্নীতি এক গভীর ব্যাধি। সমাজকে তা ভেতর থেকে কুরে কুরে খায়।

দুর্নীতি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন দুর্বল করে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটায়, বাজার বিকৃত করে, জীবনের মান নষ্ট করে, নানা রকম অপরাধ, সন্ত্রাসী ও সমাজবিরোধীদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটায়।

আমাদের মতো দেশে দুর্নীতির প্রভাব ভয়ংকর ক্ষতিকর। উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ সম্পদ দুর্নীতির কারণে বিপথে চালিত হয়, তার ফলে দরিদ্র মানুষের বিপুল ক্ষতি হয় এবং সেটা আমরা করোনাকালে দেখেছি।

সরকারের অত্যাবশ্যক সেবা পরিষেবা দেওয়ার সক্ষমতা দুর্নীতির প্রকোপে ব্যাহত হয়। আর সেখান থেকেই বৈষম্য ও অন্যায় উৎসাহিত হয়। নিরুৎসাহিত হয় ন্যায্যতা ও সুশাসন।

দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জায়গাও ক্ষমতাবানরা নষ্ট করছে। বরং তারা সচেষ্ট দুর্নীতির একটি নাগরিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করছে। তারা বলছে, উন্নয়ন হলে কিছু দুর্নীতি হবেই।

এটি এমন ন্যারেটিভ যেটি কমবেশি সব ক্ষমতাবানরা সমর্থন করে। কিন্তু উন্নয়নের সাথে দুর্নীতির এমন সম্পর্ক কোনো তত্ত্ব বা শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। আরেকটি হলো নাগরিক সেবা পর্যায়ে দুর্নীতিতে মানুষকে অভ্যস্ত করে ফেলা।

রাজনৈতিক বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিসহ নানা অসঙ্গতির সাথে আয়ের তফাত আমাদের সমাজ কাঠামোয় বড় বৈষম্য টেনে রেখেছে বহুকাল ধরে।
এমন একটা সিস্টেম করা হয়েছে যে, টাকা না দিলে ন্যায্য সেবাও পাওয়া যাবে না। রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে বড় গ্রামগুলো খুব দ্রুত শহরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেখানকার শ্রমজীবী মানুষ কৃষি ছেড়ে নির্মাণশিল্প, হোটেল, পরিবহন, হাটবাজারের মতো নানা ক্ষেত্রে কাজ পাচ্ছে।

ছোট গ্রামগুলোয় এই সুযোগ অনেক কম। ফলে, গ্রামের সঙ্গে গ্রামের তফাত বেড়েছে। উন্নয়ন তার পরিধিতে ক্রমশই বৃহত্তর এলাকা ঢুকিয়ে নেয়, কিন্তু তার বাইরের এলাকা তুলনায় আরও পিছিয়ে পড়ে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।

দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেওয়ার আয়োজনও প্রকাশ্য। যেমন আইন করা হয়েছে, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করা যাবে না। ফলে দুর্নীতি করলেও আপনাকে ছাড় দিতে হবে যদি তিনি সরকারি কর্মকর্তা হন।

রাজনৈতিক বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিসহ নানা অসঙ্গতির সাথে আয়ের তফাত আমাদের সমাজ কাঠামোয় বড় বৈষম্য টেনে রেখেছে বহুকাল ধরে। কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং কোটিপতি বেড়েছে আর দরিদ্র মানুষ সমানতালে বেড়ে চলেছে।

অতি দরিদ্রদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে এই বৈষম্য কমানো সম্ভব না। অতি ধনী ও ধনীদের থেকে বড় আকারে সম্পদ কর আহরণ করে প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বাড়ানো যায় রাষ্ট্র একটু উদ্যমী হলেই। সেটাই মানুষের জন্য শাসন ব্যবস্থায় কিছুটা জায়গা তৈরি করতে পারে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION