শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৩ অপরাহ্ন
দেবদুলাল মুন্না :
আলফ্রেড হিচকক বলেছিলেন, ‘Happiness is a small house, with a big kitchen.’ সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা তার প্রকাশিত ‘দ্য লাইট উই ক্যারি’ বইতে একই কথা বলেছেন। এটি তার তৃতীয় বই। সিএনএন, গার্ডিয়ান এরই মধ্যে বইটির রিভিউ করেছে। কারণ বইতে অনেক অজানা ও মজার তথ্য উঠে এসেছে।
মিশেল ওবামা বইয়ে লিখেছেন, তাদের রান্নাঘরের টেবিল ভালো ছিল। সুন্দর ছিল। দিনে একবেলা হলেও পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে খেতেন এবং নিজেদের সেদিনের কাজের ফিরিস্তি গল্পচ্ছলে তুলে ধরতেন। একজন অন্যজনের কাজের সমালোচনাও করতেন। এতে তাদের পরিমিত খাওয়া হতো, কিন্তু জরুরি ভাব-বিনিময়ও হতো। তিনি বলেন, জীবনের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর কোনো পরিপাটি সমাধান বা মর্মস্পর্শী উত্তর অনেক সময় নাও থাকতে পারে। কিন্তু পরিবর্তনগুলোকে আরও ভালোভাবে নেভিগেট করতে এবং প্রবাহের মধ্যে স্থির থাকতে সাহায্য করার জন্য আমরা সবাই একটি সরঞ্জামের সেট খুঁজে পেতে ও তার ওপর নির্ভর করতে পারি। তাই দরকার সব রাজনীতিবিদের ঘরে একটা ‘রান্নাঘরের টেবিল’। এই টেবিলটি পারিবারিক ঘরেও থাকা জরুরি। এটি রাজনৈতিক সংলাপের জন্য জরুরি। এই টেবিল অনেকেই মেইনটেইন করতে পারেন না। তাই রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়ে।
মিশেল ওবামা জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্প যেদিন ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন সেদিন পাক্কা বিশ মিনিট কেঁদেছিলেন। এই ভেবে যে, তার তো রান্নাঘরের টেবিলে বসে কথা বলার অভ্যাসই নেই। এটি তিনি শুনেছিলেন ট্রাম্পের সাবেক বান্ধবী হেলসিয়ার কাছ থেকে। ট্রাম্প খাবারের টেবিলেও কোনো কথা বলেন না পারতপক্ষে। এক মনে ওয়াইন আর খাবার খান। পরিমিতিবোধ নেই। প্রচুর খান। এসবই হেলসিয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি জানেন। এ ছাড়া কান্নার আরেকটি কারণ অবশ্য ছিল, একসঙ্গে ওবামা ও তিনি আটটি বছর হোয়াইট হাউসকে আগলে রেখেছিলেন।
রান্নাঘরের টেবিল বলতে আসলে একসঙ্গে বসে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর কথাই তিনি বলতে চেয়েছেন।রান্নাঘরের টেবিল ছিল না বলেই এমন ছিলেন ইয়াহিয়া, দাবি ছিল বেনজির ভুট্টোর।
এই হুটহাট সিদ্ধান্তের একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এখন মার্চ মাস চলছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে কী হয়েছিল শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া খানের বৈঠকে? বিবিসি ও ইত্তেফাকের সে সময়ে প্রতিবেদন থেকে জানা যায়
ঢাকা তখন শেখ মুজিবের নির্দেশে চলছে। অসহযোগ আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ক্ষোভে উত্তাল পুরো দেশ। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। ১৬ মার্চ প্রথম বৈঠক। পরপর চারটি বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু সেই আলোচনায়, সংবিধান কেমন হবে সে বিষয়ে ৬ দফার ওপরই গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তেইশ তারিখেই এ বিষয়ে একটি খসড়া হস্তান্তর করা হয় ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের কাছে।
চব্বিশ তারিখে চূড়ান্ত বিবৃতি কী হবে সেটা আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোন করে জানানোর কথা ছিল পাকিস্তানি পক্ষের।
কিন্তু জানানো হয়নি। উল্টো ২৫ মার্চ রাত থেকে হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন ইয়াহিয়া খান। মজার ব্যাপার, সেই বৈঠকগুলোতে শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে ভালো খাবারের আয়োজন ছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া সেসব কিছুই খাননি বলা যায়, যা খেয়েছিলেন সেটা নিছক যেন দায়ে পড়ে। খেয়েছেন নিজের বয়ে নিয়ে আসা খাবার। এই যে খাবারের টেবিলেও অন্যের দেওয়া খাবারকে অসম্মান করা, এটা ইয়াহিয়ার বৈরী মনোভাবেরই প্রকাশ।
আমরা ওয়ান ইলেভেনের সময় জানি, দুই নেত্রী যখন জেলে তখন একটা খবর অনেক পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছিল শেখ হাসিনা নিজে রান্না করে খালেদা জিয়ার জন্য খাবার পাঠিয়েছিলেন এবং সেটা খালেদা জিয়া খেয়েছিলেন। মানে গভীর সংকটে নৈকট্য দরকার দুই নেত্রীই একটু হলেও বুঝেছিলেন। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের পর, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন সরকার গঠন হলো ও পরে একটি জাতীয় নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে সংলাপের জন্য গণভবনে নৈশভোজে দাওয়াত দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, সেটা নিয়েও কথা আছে। এ সময় দুজনের যে আলাপ হয়েছিল সেসব বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভিসহ ইউটিউবে এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে। সেই দাওয়াতে যাননি খালেদা জিয়া। পরে কোকোর মৃত্যুর পর শেখা হাসিনা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে তার বাসায় গেলেও, খালেদা জিয়া দেখা করেননি।
তবে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে খালেদা জিয়া গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। সেটা ২০১৬ সালে। প্রথমে ফলের শরবত দেওয়া হয়। পরে কাজুবাদাম, চিকেন পেটিস, ফিশফিঙ্গার, চিকেন স্যান্ডউইচ, গুড়ের সন্দেশ, শেষে চা এবং কফি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এ রকম শেখ হাসিনার দাওয়াতে যেতে পারতেন খালেদা জিয়া। কিন্তু না যাওয়ায় সংলাপের সম্ভাবনা বন্ধ হয়।পরের ফলাফল সবাই জানেন।
আমরা শেখ হাসিনার নিজের রান্না করা, মাছ ধরা, খাওয়ানোর পারিবারিক ছবি মাঝেমধ্যেই দেখি। এ ছবিগুলো আমার ধারণা, তার বিরুদ্ধ শিবিরের সমর্থকরাও নিশ্চুপ পছন্দ করেন। যত সময় যাচ্ছে, দেশে জাতীয় নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। আশা করছেন অনেকে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হোক। সংলাপ হোক খাবার টেবিলে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির বাড়িতে শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন। মেন্যু ছিল ১৯ পদের, যা নিয়ে ফেসবুকে অনেকে ট্রল করেছেন। দুপুরের খাবারের মেন্যুতে ছিল রুই মাছের দোপেঁয়াজা, কাতল মাছের দোপেঁয়াজা, চিতল মাছের দোপেঁয়াজা, আইড় মাছের দোপেঁয়াজা, পাবদা মাছের দোপেঁয়াজা, গোলসা টেংরা মাছ দোপেঁয়াজা ও কালবাউশ মাছের দোপেঁয়াজা।
এ ছাড়া ছিল শোল মাছ ভুনা, বাইম মাছ ভুনা, চিংড়ি মাছ ভুনা, বোয়াল মাছ ভুনা, গ্রাস কার্প ভুনা, বাচা মাছ ভুনা, রিঠা মাছের ঝোল, পাঙাশ মাছের ঝোল, মসুর ডাল, সালাদ এবং রসমালাই। কিন্তু এটা কেন ট্রল হলো বোঝা গেল না। এটা হচ্ছে বাঙালির আতিথেয়তা।
শেষ করি, একটা শহরের কথা বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান্টা ফে নামে এক প্রাচীন শহর রয়েছে। সেই শহরে রয়েছে একাধিক জাদুঘর। সেই একাধিক জাদুঘরে রয়েছে রান্নাঘরের জিনিসপত্রে ঠাসা। থালা, গ্লাস, কত কী? এগুলো ব্যবহার করত রেড ইন্ডিয়ানদের এক প্রজাতি নাভাহো ইন্ডিয়ানরা। এই রান্নাঘরের টেবিলেই বোনা হয় পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে ভালোবাসার সুতা।
এই একই কথা বললেন ইরানের মেয়ে সামিন নোসরত। থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। বইয়ের নাম ংধষঃ ভধঃ ধপরফ যবধঃ। বলেছেন, পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন আর রান্নাঘর সামলানোর ব্যাপারটি শুধু নারীর মধ্যে নেই। এখন নারীও জব মার্কেটে, পুরুষও। ফলে রান্নাঘরেও পুরুষকে ভূমিকা রাখতে হয়। এটাই সভ্যতা। সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা হয় রান্নাঘর থেকেই। ভালোবাসা হয় রান্নাঘরের টেবিলে।
সামিন নোসরতও মিশেল ওবামার মতো মনে করেন, বিশ্বের সব রাজনীতিককেই রান্নাঘরের টেবিলকে রাজনৈতিক সমঝোতার নতুন ফেনোমেনা হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
debdulalm914@gmail.com