বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সংলাপের আভাস ও খালেদা জিয়ার রাজনীতি

জাকির হোসেন :
দেশে অপশক্তির শাসন। হোদল রাজা আর বুদ্ধ রাজা মিলে ঠিক করলেন, এই অপশক্তিকে সরাতে হবে। তাই তাদের এক হতে হবে। এবার হোদল-বুদ্ধ এক হয়ে লড়াই করতে থাকে অপশক্তির বিরুদ্ধে। অপশক্তি পরাস্ত হয়। দূর হয় দেশ থেকে। কিন্তু এবার দেখা দিল নতুন সমস্যা। কে হবে রাজা? তারা দুজনই একমত হলেন, জনগণ যাকে বেছে নেবে সেই হবে রাজা। জনগণ বেছে নিল হোদলকে। কিন্তু বুদ্ধ কি তা মানতে পারে? কিছু দিন যেতে না যেতেই বুদ্ধ রাজসিংহাসন থেকে হোদলকে উৎখাত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সফল হয়। এবার রাষ্ট্রে বুদ্ধের শাসন। কিন্তু তা কি হোদলের পক্ষে মানা সম্ভব? হোদল চেষ্টা চালায় বুদ্ধকে উৎখাতের। সেও সফল হয়। আবার এলো হোদলের শাসন। কিন্তু না, এবারও শান্তি দিল না বুদ্ধ। আবার শুরু হয় দুজনের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদ। তাদের এই ঝগড়া ফ্যাসাদে দেশের জনগণের অবস্থা কাহিল। বিজ্ঞজনরা হোদল-বুদ্ধকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানায়। কিন্তু আলোচনায় বসলে কী হবে, দুজনই অনড় নিজ নিজ অবস্থানে। আর এ সুযোগে রাষ্ট্র চলে যায় আবার অপশক্তির হাতে। গল্পটা কাল্পনিক হলেও আমাদের দেশের রাজনীতির সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায়। দেশের প্রধান দুই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে ঘিরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির মাঠে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। রাজনীতির মাঠে সহনশীলতার অভাবে বরাবরই জনগণকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক দেশ রূপান্তরে প্রধান শিরোনাম ছিলে ‘উত্তপ্ত রাজনীতিতে সংলাপের হাওয়া’। খবরটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য আশাব্যঞ্জক। যদিও আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংলাপের ইতিহাস মোটেই ইতিবাচক নয়। বিগত সময়ে বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনীতিতে শান্তি ফেরাতে বেশ কয়েকটি সংলাপের আয়োজন হয়েছে। আর এসব আলোচনা নিজেদের অবস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা পরিস্থিতির কারণে ব্যর্থ হয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে। বলা হয় বিরোধী দলকে কোণঠাসা অবস্থায় রেখে রাষ্ট্র শাসন করছে সরকার। বিদেশি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো বরাবরই গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দুই কূটনীতিক। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাগিদ ছিল তাদের। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে বিরোধী দলকে রাজনীতির মাঠে সুযোগ দেওয়া ও সংলাপে বসে সমস্যা সমাধানের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে আবার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়ে উঠেছে সংলাপ।

১৯৮৪ সালে এরশাদের শাসনামলে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে দলগুলোর সঙ্গে জেনারেল এরশাদের সংলাপ হয়েছিল। সে সংলাপ তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এরশাদের শাসনামলের পাতানো নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন আ স ম রব এবং তিনি এরশাদের পতনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন।

পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সংলাপ আহ্বান করলেও সে সংলাপ খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। ২০০১ সালে জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল ও বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার দীর্ঘদিন ধরে চলা সংলাপেও সংকটের সুরাহা হয়নি। ২০১৩ সালে তারানকোর মধ্যস্থতায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো ফলপ্রসূ ফল আসেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংলাপসংক্রান্ত কোনো সমাধান আসেনি বিশেষ করে রাজনৈতিক মাঠে। কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংলাপ নিয়ে জনগণসহ অন্য দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের মাঝে হতাশার চিত্রই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

বিগত কয়েকটি সংলাপে দেখা গেছে, সরকার এবং বিরোধীদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নীতির কারণে সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে। সংলাপে অংশগ্রহণ করা মানে ধরে নিতে চাই চলমান সংকটের সমাধান হবে। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে এ সংলাপের আয়োজন, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে নয়। তবু দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে সফল হয় না।

এবারও যদি সংলাপ হয় তবে ধারণা করা যায়, এই সংলাপও ব্যর্থ হবে। কারণ রাজনীতির ময়দানে অন্যতম বৃহত্তর দল বিএনপি যেসব দাবি তুলে আন্দোলন করছে তার বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহার করার মতো ইস্যুগুলোতে সরকার কখনোই সায় দেবে বলে মনে করি না। কিন্তু এগুলো বিএনপি খুব জোরেশোরে দাবি করবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগও চাইবে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে। যেটা মানতে চাইবে না বিএনপি। ফলে সংলাপ এগোবে না।

আমরা জানি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাতিল হয়েছে। এ ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যদিও বর্তমান সরকারের পক্ষে এটা সম্ভব, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে করবে কেন? এই ব্যবস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা তো কম না। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যখন আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, তখন বিএনপি বলেছিল পাগলের প্রলাপ। আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে এ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে বিএনপি সরকারকে বাধ্য করেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হয়েছিল। যে কারণে আওয়ামী লীগের হাত ধরেই এ ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। এটা ভালো দিকই বলা যেতে পারে।

এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এক সময় ছিল না। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অধীনে যে নির্বাচনের আয়োজন হয়েছিল সেটাতে সব দলের সায় ছিল। যদিও তা আমাদের সংবিধানের মধ্যে ছিল না। পরবর্তীতে তার বৈধতার ফর্মুলা দিয়েছিল আজকের প্রধান দুই দল। তাই সংলাপ কার্যকর করতে হলে, দুই দলকে নতুন কোনো ফর্মুলা দিতে হবে, যা দিয়ে রাজনৈতিক সংকট দূর হয় এবং দেশ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলে বিরোধী দলকে রাজনীতির মাঠে সুযোগ দেওয়ার আহ্বানের পর হঠাৎই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নবনিযুক্ত সহকারী জজদের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে বলেছেন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই। তবে নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আইনমন্ত্রীর এই উক্তি রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যদিও খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত। খালেদা জিয়া নিজেও এই মুহূর্তে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারছেন না। নিজের সুস্থতাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। সেখানে আইনমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতির মাঠে আহ্বানের বিষয়টি ভিন্ন জন ভিন্নভাবে দেখছেন। কারও কারও মতে, খালেদা জিয়াকে রাজনীতির মাঠে আহ্বান আইনমন্ত্রী জেনে বুঝেই করেছেন। কারণ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি ভালোই অবগত আছেন। তার এই আহ্বান অনেকটাই লোকদেখানো মনে হতে পারে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী দলকে রাজনীতির মাঠে সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, সেহেতু আইনমন্ত্রী অসুস্থ খালেদাকে রাজনীতির মাঠে আহ্বান করে দেখাতে চাইছে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। অথবা সরকার চাইছে, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পেতে নির্বাচনের আগে বিএনপিকে চাঙা হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। যাতে বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

আইনমন্ত্রী ওই অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া মুক্তির আদেশে রাজনীতি করতে পারবেন না বলে কোনো শর্ত ছিল না। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪০১ ধারায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাজা স্থগিত করেছেন। তিনি একজন স্বাধীন ব্যক্তি, তাই তার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে কোনো বাধা নেই।’ আইনমন্ত্রী আরও বলেছেন, খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হয়েছে। তাই সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। যদিও দেশের সব নাগরিকের রাজনীতি করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। খালেদা জিয়া একজন রাজনীতিকই নন, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। আর শর্তসাপেক্ষে মুক্তিতে রাজনীতি করতে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারবেন। এটা বলার কিছু নেই। তাই বোঝাই যায়, সরকার বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে সুযোগ দিচ্ছে জাহির করতেই হঠাৎ এই মন্তব্য করেছেন। তবে খালেদা জিয়া রাজনীতির মাঠে ফিরেও বিএনপির দাবি আদায়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন কি না তা সন্দেহ আছে। অনেক দিন দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগহীনতা এবং মাঠ পর্যায়ে দলীয় অবস্থার পূর্ণাঙ্গ চিত্র নেই তার হাতে। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতাও তার নেই। ফলে খালেদা জিয়ার রাজনীতির মাঠে আসা না আসা বিএনপির জন্য খুব একটা প্লাস পয়েন্ট হবে না। তবে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার কারণে ভোটের মাঠে প্রভাব পড়তে পারে। আর এ কারণে বিএনপি সংলাপে বসলেও তাদের মূল দাবিগুলো জোরোলোভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করবে।

তবে সংলাপ হোক এটা প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। সংলাপ থেকে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে নতুন কোনো ফর্মুলা আসতে পারে। পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং আগামী নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। কেননা, জাতি অধীর অপেক্ষায় আছে, একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের।

লেখক: সাংবাদিক

zakpo174@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION