বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকি হ্রাসের উপায়

মোতাহার হোসেন:
বাতাসে কার্বন নির্গমন ক্রমশ বাড়তে থাকায় উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমন্ডল। পাশাপাশি পৃথিবীতে গাছপালা, বৃক্ষরাজি কমে যাওয়ায় বায়ুম-লের আর্দ্রতা ও উত্তপ্ত অবস্থা লাঘব না হওয়ায় ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হচ্ছে। এর প্রভাবে বরফাচ্ছাদিত হিমালয় পর্বতসহ পৃথিবীর অপরাপর বরফাচ্ছাদিত হিমবাহ ও পর্বতের বরফও গলছে সমভাবে। পৃথিবীর বরফাচ্ছাদিত পর্বতসমূহের বরফ গলে সেই পানি সমুদ্রে পতিত হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো ঝুঁকিতে আছে। অতিসম্প্রতি এই ঝুঁকির তথ্য নিরাপত্তা পরিষদকে জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস বাড়ার কারণে প্রায় দুই কোটি মানুষ গৃহহীন ও আশ্রয়হীন হবে। এমন পূর্বাভাস পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের। তাদের মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস বাড়লে সমুদ্রের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে, খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকিও বাড়বে সমহারে।

বিশ্বের প্রতি ১০ জনের একজন মানুষ এই মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী সহনীয় পর্যায়ের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত হচ্ছে। যার কারণে হিমবাহ ও বরফ গলে যাচ্ছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, অ্যান্টার্কটিকায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টন বরফ গলে যাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ড প্রতি বছর ২৭০ বিলিয়ন টন বরফ হারাচ্ছে। জাতিসংঘ প্রধান বলেন, গত শতাব্দীতে বিশ্বে মহাসাগর সবচেয়ে বেশি দ্রুত উষ্ণ হয়েছে। বিশ্ব ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণায়নের সীমা অতিক্রম করছে। এটি ২.৮ ডিগ্রির দিকে যাচ্ছে। এভাবে উষ্ণতা বৃদ্ধি, দুর্বল দেশগুলোর জন্য কার্যত ‘মৃত্যুদন্ড’।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, হিমালয়ের বরফ গলে এরই মধ্যে পাকিস্তানে বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু আগামী কয়েক দশকে হিমালয়ের হিমবাহ কমতে থাকায় সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীগুলো আরও সংকুচিত হবে। এমনকি নিচু দেশগুলো চিরতরে অদৃশ্য হয়েও যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে। ফলে জলবায়ু তহবিলের জন্য ১০০ বিলিয়ন অর্থ প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবেশবিদদের মতে, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭ শতাংশেরও বেশি জমি পানির নিচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নদীভাঙন ও ঝড়ো জলোচ্ছ্বাসের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের দুই কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য মূলত আমরাই দায়ী। পাশাপাশি অতিমাত্রায় ভোগবিলাসী জীবনযাপনই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে পানির আয়তনও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া মরু অঞ্চল ও পর্বতচূড়ায় অবস্থিত বরফ গলে যাওয়ার ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ থেকে ৩৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় বড়সড় কোনো ভাঙন দেখা দিলে এটা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সারা বিশ্বের নিম্নাঞ্চলের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক আন্তঃসরকার সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) একটা গবেষণা বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার (৩৯.৩৭ ইঞ্চি) বাড়লে বাংলাদেশের ১৭-২০ শতাংশ স্থলভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর প্রণীত বাংলাদেশের জাতীয় কৌশলনীতির তথ্যানুসারে দেশের আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। নাসার সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার ঘনত্ব ও সীমিত সম্পদের কারণে পরিবেশ-উদ্বাস্তুদের অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা কষ্টসাধ্য হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ, যাদের সম্পদ সীমিত, তাদের পক্ষে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর হবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে। উপকূলীয় অবকাঠামো সমুদ্রবন্দর, রাস্তাঘাট ও রেলসংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন্দরসমূহের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যাহত হবে। এর ফলে সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর ও রাষ্ট্রসমূহের মানুষকে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পাবে, যা রাষ্ট্রসমূহকে ভঙ্গুর করে তুলবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র, যেমন নিউ ইয়র্ক, সাংহাই, মুম্বাই এগুলো সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। এই অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিগুলো যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা সাময়িকভাবেও যদি এদের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়ে যাবে। উপকূলে অবস্থিত পর্যটনশিল্পের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হবে। বাংলাদেশে যে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটছে, তা হয়তো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। বরং বৃদ্ধির হার কতটা কমিয়ে রাখা যায়, সেটাই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যেসব নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে, তা মোকাবিলার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের যৌথ পদক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক উদ্যোগ। তাহলেই পৃথিবীর মানুষকে, ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

motaherbd123@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র:দৈনিক দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION