বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সেন্টমার্টিনে রাজত্ব চালাচ্ছেন কারা!

ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন নিয়ন্ত্রণ করছে ১৩ পরিবার। জমি বিক্রি, রিসোর্ট তৈরি কিংবা সেখানে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করতে গেলে লাগবে তাদের সুদৃষ্টি। পরিবারগুলো খুশি থাকলে যে কেউ প্রাসাদও তৈরি করতে পারেন সেখানে। ৫০ বছর ধরে তারা বলতে গেলে এলাকাটি শাসন করছেন। তাদের পেছনে আছেন উপজেলার প্রভাবশালীরা।

এ ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ছোট ছোট দোকানপাটের মধ্যে বেশির ভাগেরই মালিক ওই ১৩ পরিবারের সদস্যরা। এক চেটিয়াত্বের কারণে যে যার মতো পারছে পর্যটকদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। পর্যটকরা কারও কাছে প্রতিকার চাইতে পারছেন না।

জানতে চাইলে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের উন্নয়নের জন্য আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি। তবে বেশ কিছু সমস্যা আছে। সেগুলোও সমাধানের চেষ্টা চলছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে রিসোর্টসহ অন্যান্য স্থাপনা যাতে কেউ নির্মাণ করতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। যারা আইন মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

১৩ পরিবারের বিষয়ে তিনি বলেন, এ পরিবারগুলোর কর্তাব্যক্তিরা কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তাদের স্বজনরা আছেন। তাদের জায়গা-জমি আছে। সেগুলো হয়তো তারা কেনাবেচা করেন।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন নিয়ে আমরা আলাদা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সেন্টমার্টিনে নিরাপত্তার বিষয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। কোনো গ্রুপ বা মহল পর্যটকদের জিম্মি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ট্রলার বা স্পিডবোটগুলো আলাদাভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। পর্যটকরা কোনো ধরনের সমস্যায় পড়লে তাৎক্ষণিক পুলিশকে অবহিত করার অনুরোধ জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত এ দ্বীপে প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক আসেন। এখানে স্থানীয়দের পাশাপাশি বাইরের প্রভাবশালীদেরও হোটেল ও রিসোর্ট আছে।

সেন্টমার্টিনে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের কথা বলে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন কারা নিয়ন্ত্রণ করেন। পর্যটন খাতসমৃদ্ধ হলেও যোগাযোগ, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক অনেক সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যোগাযোগ। জরুরি কাজে টেকনাফ ও জেলা সদর কক্সবাজার আসা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে বেশ কটি জাহাজে পর্যটকরা দ্বীপে আসা-যাওয়া করেন। টেকনাফ থেকে স্পিডবোট থাকলেও শুষ্ক মৌসুম ছাড়া চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে জাহাজভাড়া। তার সঙ্গে রয়েছে ঘাটে চাঁদাবাজি। বর্তমানে টেকনাফের দমদমিয়া থেকে জাহাজভাড়া যাওয়া-আসা জনপ্রতি ১২০০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন হাজার টাকার বেশি লাগে। এ ছাড়া ঘাটের ইজারাও বেশি আদায় করা হচ্ছে। সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়াদ্বীপে যাওয়ার সময় বেশি ভাড়া হাঁকা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি স্পিডবোটচালক জানান, প্রতি মাসে স্থানীয় নেতাদের চাঁদা দিতে হয়। ১৩ পরিবারের কেউ না কেউ চাঁদা তোলেন। তারা নিজেদের শ্রমিক লীগ নেতাকর্মী দাবি করেন। তবে চাঁদার বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয় না। চাঁদা দেওয়ার কারণে পর্যটকদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নিতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘অদৃশ্য শক্তি’র ইশারায় ১৩ পরিবার সব অপকর্ম চালাচ্ছে। তাদের সঙ্গে একটি প্রভাবশালী মহলের ইন্ধন রয়েছে। জায়গা বিক্রি করতে হলে তাদের অনুমতি নিয়ে করতে হচ্ছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা দোকানপাট তৈরি করে ব্যবসা চালাচ্ছেন।

তাদের মধ্যে এক ব্যবসায়ী জানান, বছর-তিনেক আগে সেন্টমার্টিন বাজার থেকে পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে একটি আবাসিক হোটেল করতে ২০ শতাংশ জমি পছন্দ করেন। জমিটি টেকনাফের এক ব্যবসায়ীর। দর-কষাকষির পর্যায়ে জমির মালিক টালবাহানা করতে থাকেন। পরে স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে হাসেনা বারোর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। পরে জানা যায়, হাসেনা বারোর পরিবারটি প্রভাবশালী পরিবারগুলোর একটি। মূলত তাদের মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকা দিয়ে জমিটি কিনতে হয়েছে। জমির মালিক সেন্টমার্টিন থাকেন।

একই কথা বলেছেন ঢাকার আরেক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ১৩ পরিবারের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন অবহিত আছে। জায়গা কেনাবেচার সঙ্গে তারা জড়িত। তাদের একটি পরিবারের মাধ্যমে ১০ বছর আগে সেন্টমার্টিন বাজারের পাশে একটি জায়গা কিনেছিলেন তিনি। বর্তমানে জমির দাম প্রায় দুই কোটি টাকা।

১৩ পরিবারের সদস্যরা সাগরের পাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে হকারদেরও নিয়ন্ত্রণ করেন। পর্যটকদের যারা ছবি তোলেন তারাও তাদের লোক। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় লোকজনও তাদের সহায়তা করেন।

স্থানীয় লোকজনের মধ্যে প্রচলিত ১৩ পরিবারের নাম দুইব্রা বারো, শেয়ানদারা বারো, তইজ্রাহাতু বারো, আহমেইদ্রা বারো, গুলাবারো, লোকমালা বারো, সারো বারো, হাসেনা বারো, ছইন্না বারো, লাঠিম মিয়া, জুলহাইস্রা বারো, আবদুল হক বারো ও ইসহাক বারোর পরিবার সেন্টমার্টিন নিয়ন্ত্রণ করে। এসব পরিবারের মধ্যে অনেকেই কোটি টাকার মালিক।

ইসহাক বারোর পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য আবদুর রশীদ বলেন, ‘১৩ পরিবার ছাড়া কেউ এখানে ব্যবসা করতে পারে না। সেন্টমার্টিনের বাইরে থেকে আসা লোকজন তাদের ম্যানেজ করে হোটেল, রিসোর্ট তৈরি করছে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার দাদি জুলেখা বিবির কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে ২২ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। পরে তিনি রিসোর্ট তৈরি করেন। বর্তমানে জমিটির মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। এখানে জমির দাম আকাশছোঁয়া।

রশীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৩ পরিবারকে ম্যানেজ করে কেউ কেউ অবৈধভাবে রিসোর্ট ও টংঘর তৈরি করে ব্যবসা করছেন। এজন্য প্রশাসনের একটি চক্রকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, কয়েক মাস আগে স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তবে বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নির্মাণাধীন অবৈধ স্থাপনা অক্ষত রেখে শুধু লোকদেখানো অভিযানে ছোট ছোট টংঘর ও ত্রিপল দিয়ে করা দোকান, বাঁশের বেড়ার ভাসমান স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। প্রভাবশালীদের একটি অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ হয়নি। বরং অবৈধ ভবনগুলোর নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে।

রিসোর্টের রুম ভাড়াও নির্ধারিত থাকে না। যে রুমের ভাড়া হওয়ার কথা এক হাজার টাকা, সেই রুমের ভাড়া রাখা হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম নিয়েও নৈরাজ্য আছে। ঘাটে হয়রানির সমস্যা তো আছেই।

আপেল শাহরিয়ার ও আজাদ রহমান নামের দুই পর্যটক বলেন, ১৫ দিন আগে তারা ঢাকা থেকে টেকনাফ যাওয়ার পর জাহাজে সেন্টমার্টিন গিয়েছেন তারা। যাওয়ার পথে নানাভাবে হয়রানি হতে হয়েছে। সেন্টমার্টিনে একাধিক চক্রের কাছে পর্যটকদের জিম্মি থাকা, নিরাপত্তার অভাব, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার কথা জানান।

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION