মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক:
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ নবী। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না। সুতরাং পরবর্তী উম্মতরা কীভাবে সত্যের দিশা পাবে এবং তার ওপর টিকে থাকতে পারবে সে প্রশ্নটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবী কারিম (সা.) বিদায় হজের ভাষণে উম্মতকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। কোরআন ও সুন্নাহ। যতক্ষণ তোমরা এই দুটি বিষয় ধরে রাখবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না।’ -মুয়াত্তায়ে মালিক : ১৬২৮
হাদিসে নবী কারিম (সা.) সত্যপথ চেনা ও বোঝার দুটি মানদণ্ড উল্লেখ করেছেন। এক. কোরআন, দুই. সুন্নাহ (হাদিস)।
ইসলামি শরিয়তে হক (সত্য) নির্ণয়ের মাপকাঠি হলো কোরআন ও সুন্নাহ। পাশাপাশি সেসব বিষয় যাকে কোরআন-সুন্নাহ হক নির্ণয়ের মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেগুলোর আলোকেও নিজেকে মেপে নিতে হবে।
বর্তমান সমাজে কোরআন-সুন্নাহ ও তার অনুমোদিত বিষয় বাদে এমন কিছু বিষয়কে সত্যের মানদণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা শরিয়তে সত্যের মাপকাঠি হিসেবে অনুমোদিত নয়। যেমন
স্বপ্ন : নবীদের স্বপ্ন ছাড়া আর কারও স্বপ্নকে শরিয়ত দলিলের মর্যাদা দেয়নি। শরিয়ত স্বপ্নকে শুধু সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারীরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে; এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ভালো স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে আর মন্দ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। কেউ খারাপ স্বপ্ন দেখলে বাম দিকে থুথু দেবে এবং আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং এ স্বপ্ন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর এ দুঃস্বপ্নের কথা কারও কাছে বলবে না। অপরদিকে ভালো স্বপ্ন দেখলে সুসংবাদ গ্রহণ করবে এবং এ স্বপ্নের কথা মহব্বতের লোকদের কাছেই বর্ণনা করবে।’ -সহিহ মুসলিম : ২২৬১
রাসুলে আকরাম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল সে সত্যই আমাকে দেখল। কারণ, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।’ -সহিহ মুসলিম : ২২৬৬
তবে নবী কারিম (সা.)-কে দেখা স্বপ্নও ইসলামি শরিয়তের আলোকেই বিচার করা হবে। কেননা ব্যক্তি তা সঠিকভাবে স্মরণ রাখতে পেরেছে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা আলোচ্য হাদিসে দেওয়া হয়নি।
কাশফ ও ইলহাম : কাশফ হলো অদৃশ্য জগতের কোনো কথা প্রকাশিত হয়েছে বলে ধারণা হওয়া আর ইলহাম অর্থ চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোনো কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। স্বপ্নের মতো কাশফ-ইলহামও ইসলামি শরিয়তের দলিল নয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষের অন্তরে শয়তানের পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়, ফেরেশতার পক্ষ থেকেও কথার উদ্রেক হয়। শয়তানের উদ্রেক হলো, মন্দ প্রতিশ্রুতি ও সত্য অস্বীকার করা। আর ফেরেশতার উদ্রেক হলো, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি ও হকের সত্যায়ন। যে ব্যক্তি এটি (ভালো কিছুর উদ্রেক) অনুভব করবে তাকে বুঝতে হবে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই তার উচিত আল্লাহতালার প্রশংসা করা। আর যে দ্বিতীয়টি (খারাপ কিছুর উদ্রেক) অনুভব করবে সে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে।’ -সুনানে তিরমিজি : ২৯৮৮
আর যে বিষয়টি ভালো-মন্দ উভয় সম্ভাবনা রাখে তা কখনো শরিয়তের দলিল ও হক-বাতিলের মাপকাঠি হতে পারে না। কোরআন-সুন্নাহ ও ইসলামি শরিয়তের আলোকে কাশফ-ইলহাম যাচাই করে নিতে হবে।
নির্দিষ্ট জায়গা : পথভ্রষ্টার আরেকটি দিক হলো, নির্দিষ্ট কোনো জায়গাকে সত্যের মাপকাঠি বানানো এবং এর ভিত্তিতে হক না-হকের ফায়সালা করা। পৃথিবীর সবচেয়ে বরকতপূর্ণ স্থান মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার এই মসজিদের একটি (ওয়াক্ত) নামাজ অন্য জায়গার এক হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম, মসজিদে হারাম ভিন্ন। মসজিদে হারামের এক রাকাত নামাজ অন্য জায়গার এক লাখ নামাজের চেয়ে উত্তম।’ -মুসনাদে আহমাদ : ১৪৬৯৪
কোরআন-হাদিসের কোথাও এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি কিয়ামত পর্যন্ত এই দুই মসজিদের মিম্বর থেকে যা কিছু বলা হবে সব হক! এই দুই মসজিদে কখনো কোনো বিদআত, কোনো গোমরাহি আসন গাড়তে পারবে না। আর বাস্তবতাও তাই। জাহেলি যুগে বাইতুল্লাহ কাফের-মুশরিকদের দখলে ছিল। সেখানে মূর্তিপূজা হতো, সেখান থেকে কুফর-শিরকের আওয়াজ আসত। পৃথিবীর আরেক পবিত্র স্থান বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কোনো ভূখণ্ড কাউকে পবিত্র করতে পারে না। মানুষ পবিত্র হতে পারে একমাত্র আমলের মাধ্যমে।’ -মুয়াত্তা মালিক : ২৮৪২
ব্যক্তিবিশেষের অন্ধ অনুসরণ : ব্যক্তিবিশেষের অন্ধ অনুকরণ মুসলিম সমাজের নানাবিদ সমস্যা ও সংকট তৈরি করেছে। বিশেষত যে ব্যক্তি বা পিরের মাধ্যমে মানুষ দ্বীনের পথে আসে তার ব্যাপারে কোনো সমালোচনা শুনতে সে প্রস্তুত থাকে না। অথচ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র। তার আগে আরও বহু রাসুল গত হয়েছে। যদি সে মারা যায় বা নিহত হয়, তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না; বরং আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৪৪
কোনো বিশেষ বংশধারা : কোনো বিশেষ বংশধারা বা খানদানকে সত্যের মাপকাঠি মনে করা ইসলামি শরিয়তের মূলনীতি বিরোধী। কোনো বংশধারা যদি হকের মাপকাঠি হতো তবে নবী কারিম (সা.)-এর খানদানকেই হকের মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করা হতো। কিন্তু কোরআন-সুন্নাহে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি নিজেও তা কখনো ঘোষণা করেননি। বরং বলেছেন, ‘আমল যাকে পিছিয়ে রেখেছে বংশ তাকে এগিয়ে নিতে পারে না।’ -সহিহ মুসলিম : ২৬৯৯
সাধারণ জনতার ঢল : সাধারণ জনতার ঢলও মাপকাঠি নয়। সাধারণদের মধ্যে ওই বিশিষ্টজনেরাও আছেন, যাদের জাগতিক শিক্ষা আছে, পদ আছে, ক্ষমতা আছে, কিন্তু দ্বীনি ইলম নেই, শরিয়তের মূলনীতি ও হকের মাপকাঠি সম্পর্কেও সঠিক ইলম নেই; তারাও শরিয়তের দৃষ্টিতে সাধারণ। এরা কোনো পক্ষ গ্রহণ করার বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। তবে যারা শরিয়তের দলিল দিয়ে হক-বাতিলের বিশ্লেষণ করতে জানেন এমন জনতার ঢলকে দলিল ও মাপকাঠি বানানো যায়? হ্যাঁ, এই জনতার ঢল যদি হকের পক্ষে থাকে, আল্লাহর শোকর করা এবং বলা আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ এদের সহিহ রাস্তায় রেখেছেন।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2024 Coxsbazar Voice. All rights reserved.