মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৫৬ পূর্বাহ্ন
মুফতি ইবরাহীম আল খলীল:
সমাজে শান্তি তখনই স্থায়ী হয়, যখন মানুষের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ থাকে। অন্যায়ের অন্ধকার যত ঘন হয়, ততই ভীত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। বিশেষত জোরপূর্বক অর্থ আদায় বা চাঁদাবাজির মতো অপরাধ যখন মাথাচাড়া দেয়, তখন নষ্ট হয় ন্যায়বোধের ভিত্তি। আমাদের আশপাশে প্রতিদিনই ঘটছে এমন সব ঘটনা, যা মানুষের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। অথচ ইসলাম এসেছে এই নিরাপত্তাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে। মানুষের হক রক্ষা করা এবং প্রত্যেককে তার প্রকৃত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ইসলামের মূল শিক্ষা। তাই চাঁদাবাজির মতো অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইসলাম। ইসলাম একদিকে মানুষের সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে সমাজকে অন্যায় ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত রাখার আহ্বান জানায়।
কারও বৈধ সম্পদ অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া গুরুতর অন্যায়। জুলুম করা বা চাঁদা আদায় করা ভয়াবহ গুনাহ এবং বড় অপরাধ। কোরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা হারাম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করো না।’ (সুরা নিসা, আয়াত ২৯)
চাঁদাবাজি আসলে ডাকাতি, ছিনতাই ও জুলুমেরই আরেক রূপ। যারা মানুষকে ভয় দেখিয়ে কিংবা প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করে, তারা সমাজের নিরাপত্তা বিনষ্টকারী এবং মুহারিব (আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী) হিসেবে গণ্য হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কারও সম্পদ অন্যায়ভাবে নেওয়া জুলুম। কেয়ামতের দিন সেই সম্পদের ব্যাপারে কঠিন হিসাব দিতে হবে।’ (সহিহ বুখারি)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমিও দখল করে, কেয়ামতের দিন তার গলায় সেটার সাত স্তর জমি ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি) চাঁদাবাজি এর চেয়েও জঘন্য। কারণ এতে জবরদস্তি ও ভয় দেখিয়ে অন্যের হক ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
চাঁদাবাজি এক ধরনের দস্যুতা। আর ইসলামের দৃষ্টিতে চাঁদাবাজি হারাম ও কবিরা গুনাহ। চাঁদাবাজির কারণে পরকালে ভীষণ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত সবাই গুনাহগার। চাঁদা উত্তোলনকারী, চাঁদা লেখক ও চাঁদা গ্রহণকারী সবাই ওই গুনাহে সমান অংশীদার।
ইসলামের বিধান হলো, কারও কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া হারাম। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করো না এবং এ উদ্দেশে বিচারকের কাছে এমন কোনো মামলা করো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনেশুনে গ্রাস করার গুনাহে লিপ্ত হবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৮)
রাসুল (সা.) বলেন, কোনো মুসলমানের সম্পদ তার আন্তরিক সম্মতি ছাড়া হস্তগত করলে তা হালাল হবে না। (শুয়াবুল ইমান)
আল্লাহর জমিনে ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপরাধে চাঁদাবাজদের জন্য চারটি শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে কোরআনে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং জমিনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে বেড়ায় তাদের শাস্তি হলো এই যে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এ হলো তাদের জন্য দুনিয়াতে লাঞ্ছনা আর তাদের জন্য আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত ৩৩)
মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া ইসলাম কখনো সমর্থন করে না, বরং ইসলামের মূল শিক্ষাই হলো ন্যায়, সুবিচার ও মানুষের হক আদায় করা। কারও অধিকার অন্যায়ভাবে হরণ করা, চুরি-ডাকাতি কিংবা চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ আদায় করা শুধু সামাজিক অপরাধ নয়, বরং এটি একটি মারাত্মক গুনাহ। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে, সে যেন আজই তার ভাইয়ের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয় ওই দিনের আগেই, যেদিন আর কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। কেননা সেদিন যদি তার নেকি থাকে, তবে মজলুমের হক তার নেকি থেকে কেটে নেওয়া হবে, আর যদি নেকি না থাকে, তবে মজলুমের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট হয় যে, অন্যের হক নষ্ট করা এক ভয়াবহ অপরাধ। পৃথিবীতে যার ক্ষমতা আছে, সে হয়তো অন্যায়ের বিচার থেকে রেহাই পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু আখেরাতের ময়দানে কোনো ক্ষমতা, কোনো ধোঁকা, কোনো সুপারিশ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। সেদিন আল্লাহর দরবারে বিচার হবে সূক্ষ্মভাবে।
চাঁদাবাজি ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বিমুখী অপরাধ। একদিকে এটি অন্যের হক কেড়ে নেওয়া, অন্যদিকে এটি সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ। যে ব্যক্তি চাঁদা তোলে, সে সরাসরি জালেম। আর যে ব্যক্তি অন্যের কাছ থেকে চাঁদার টাকা ভোগ করে বা এ কাজে সহযোগিতা করে, সেও সমানভাবে গুনাহের অংশীদার। চাঁদাবাজি সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে। মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে অপরাধের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
যারা চাঁদাবাজি করে, তারা নিজেরাই সরাসরি জালেম। আর যারা চাঁদার টাকায় ভাগ বসায়, তারা জালিমের সহযোগী। কোরআন-হাদিসে জালেম ও তার সহযোগীদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির ঘোষণা এসেছে। আজ আমাদের সমাজে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, মানুষের হক ফিরিয়ে দেওয়া এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। মহান আল্লাহ আমাদের দেশের চাঁদাবাজদেরকে হেদায়েত দান করুন। আমাদেরকেও এ ধরনের জঘন্য গুনা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : মাদ্রাসাশিক্ষক ও প্রবন্ধকার
ভয়েস/আআ