রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:০৭ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
হাদিসের বিশুদ্ধ ছয় কিতাবের অন্যতম জামে তিরমিজিতে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতায়ালার কাছে এমন একটি অন্তর থেকে আশ্রয় চেয়েছেন- যে অন্তর আল্লাহতায়ালার সামনে বিনয়ী হতে জানে না। এমন অন্তর তিনি কখনোই কামনা করেননি, যা আল্লাহর সামনে ভয়ে ও বিনয়ে কান্না করে না। আল্লাহর সঙ্গে তুলনাযোগ্য আর কিছুই নেই, এই চরম সত্যটি যে অন্তর উপলব্ধি করতে পারে না- তা থেকেও নবী কারিম (সা.) আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন।
হাদিসে বর্ণিত দোয়াটি হলো- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন কালবিন লা ইয়াখশাউ, ওয়া দুয়াইন লা ইয়ুসমাউ, ওয়া মিন নাফসিন লা তাশবাউ, ওয়া মিন ইলমিন লা ইয়ানফাউ আউজুবিকা মিন হাউলাইল আরবা।’ অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি এমন মন হওয়া থেকে যা আপনার ভয়ে ভীত হয় না, এমন দোয়া থেকে যা শোনা হয় না (প্রত্যাখ্যান করা হয়), এমন আত্মা হতে যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন জ্ঞান হতে যা কাজে আসে না। আপনার কাছে আমি এ চার জিনিস থেকে আশ্রয় চাই।’ -জামে তিরমিজি : ৩৪৮২
উল্লিখিত দোয়ায় ‘ইয়াখশা’ যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার অর্থ আল্লাহকে ভয় করা এবং এ ভয় থেকেই আল্লাহর সামনে বিনয়ী হওয়া। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা মুমিন, তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা যেন তাদের মতো না হয়ে যায়, যাদের আগে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। তারা অনেকটা সময় পেয়েছে। অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।’ -সুরা হাদিদ : ১৬
এই আয়াত মুমিনদের জন্যে হুঁশিয়ারি। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহতায়ালা কোনো কোনো মুমিনের অন্তরে আমলের প্রতি অলসতা ও অনাসক্তি আঁচ করে এই আয়াত নাজিল করেন।’ আয়াতটি কোরআন অবতরণ শুরু হওয়ার তের বছর পরে নাজিল হয়। এই হুঁশিয়ারির সারমর্ম হচ্ছে, মুসলিমদের পুরোপুরি নম্রতা ও সৎকর্মের জন্য তৎপর থাকার শিক্ষা দেওয়া।
অন্তর হলো সব নেক আমলের ভিত্তি। আমরা কে কতটা ভালো কাজ করতে পারব তা নির্ভর করে অন্তরের শুদ্ধতার ওপর। অন্তর পরিশুদ্ধ হলে তা আমাদের পাপ কাজ করতে বাধা দেয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কারণে বলেছেন, ‘শরীরের ভেতর গোশতের একটি টুকরো আছে। যদি তা বিশুদ্ধ হয়, পবিত্র হয় তাহলে সবকিছুই সুন্দর ও পরিশোধিত হয়। কিন্তু যদি এটি দূষিত হয়ে যায় তাহলে গোটা শরীরটাই দূষিত হয়ে যায়, পচে যায়। আর গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটিই হলো কালব বা অন্তর।’ -আহমাদ : ১৮৪১২
একটি অন্তর কখন ও কীভাবে আল্লাহর সামনে বিনয়ী হতে ভুলে যায়, তা হজরত উমর (রা.) খুব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে, সে নিজেকে খোলাসা (উন্মুক্ত করে দেয়) করে ফেলে। ফলে তার পাপগুলোও সামনে এসে যায়। আর যে ব্যক্তি তার পাপ উন্মুক্ত করে দেয়, সে তার অন্তর্নিহিত শালীনতা ও মার্জিত মনোভাব হারিয়ে ফেলে। আর যে ব্যক্তি শালীনতা হারিয়ে ফেলে, তার তাকওয়া আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়। আর যখনই একজন মানুষের তাকওয়া নিঃশেষ হয়ে যায়, তখনই তার অন্তর মারা যায়। মৃত অন্তর আর বিনয়ী হতে পারে না।’
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মৃত অন্তরে আবারও প্রাণশক্তি ফিরে আসে যখন মানুষ সৎ কাজ করতে শুরু করে।’ বুজুর্গ আলেমরা বলেছেন, ‘মানুষের ওপর যতগুলো বিপদ বা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বিপদ হলো- অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া। ইহুদি, মুনাফিক ও মুশরিকরা সত্যনিষ্ঠ ইসলামকে চেনার পরও মেনে নিতে পারেনি; কারণ তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গিয়েছিল। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেবল হতভাগ্য ব্যক্তির হৃদয় থেকেই দয়া তুলে নেওয়া হয়।’ -জামে তিরমিজি : ১৯২৩
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, এক বেদুইন ব্যক্তি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, আপনি কি শিশুদের চুমু দেন? আমি তো কখনো শিশুদের চুমু দিই না। তিনি তাকে বললেন, আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়া ছিনিয়ে নিয়ে অন্তরকে কঠিন করে দেন, তাহলে আমার কীই-বা করার আছে? -মিশকাত, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৪২১
বস্তুত আল্লাহতায়ালাই অন্তরের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক। তিনি যেকোনো দিকেই অন্তরকে ধাবিত করতে পারেন। এ কারণে নবী কারিম (সা.) সবসময় অন্তরের স্থিরতার জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করতেন। হজরত শাহর ইবনে হাওশাব (রহ.) থেকে বর্ণিত। উম্মে সালামা (রা.)-কে আমি বললাম, হে উম্মুল মুমিনিন! রাসুলুল্লাহ (সা.) আপনার কাছে অবস্থানকালে অধিকাংশ সময় কোন দোয়াটি পাঠ করতেন?
তিনি বললেন, অধিকাংশ সময় এ দোয়া পাঠ করতেন, ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব, সাব্বিত কালবি আলা দিনিক। অর্থাৎ হে মনের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর স্থির রাখুন।’ উম্মে সালামা (রা.) একবার এর কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি অধিকাংশ সময় ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব, সাব্বিত কালবি আলা দিনিক’ দোয়াটি কেন পাঠ করেন?
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বলেছিলেন, ‘হে উম্মে সালামা! পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যার মন আল্লাহর দুই আঙুলের মাঝখানে অবস্থিত নয়। যাকে ইচ্ছা তিনি দীনের ওপর স্থির রাখেন এবং যাকে ইচ্ছা দীন থেকে বিপথগামী করে দেন। এই হাদিসের শেষাংশে হজরত মুআজ (রা.) কোরআন মাজিদের এ আয়াত তেলাওয়াত করেন, ‘রাব্বানা লাতুজিগ কুলুবানা বাদা ইজ হাদাইতানা ওয়া-হাবলানা মিল্লাদুনকা রাহমা, ইন্নাকা আনতাল ওয়াহহাব।’ -সুরা আলে ইমরান : ০৮
অর্থ : হে আমাদের রব! আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার পর আপনি আমাদের অন্তরসমূহকে আবারও বাঁকা করে দিয়েন না। -জামে তিরমিজি : ৩৫২২
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয়ে আলোচনা জরুরি। তাহলো- মানুষ হিসেবে আমরা অন্যের তুলনায় নিজেদের দোষত্রুটি নিয়ে কম আলোচনা করি, কারণ নিজেদের নিয়ে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস কাজ করে। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড, অভিজ্ঞতা, বোঝাপড়াকে মানোত্তীর্ণ মনে করি। কিন্তু প্রতিটি মানুষের পতন হতে পারে। আধ্যাত্মিক পতন, চিন্তাগত পতন, আদর্শিক পতন। এই বিষয়টি নিয়ে কেন যেন আমরা সতর্ক হই না, হতে চাই না। সম্ভবত, অন্য অনেক কিছুর মতো হেদায়েতকে চিরস্থায়ী ধরে নিয়েছি বলেই এমনটা হয়। যদিও মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অস্থির একটি সময়ে আমরা বসবাস করছি। অতএব দোয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা এবং মনের শুদ্ধতা অর্জনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক