মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাজেট ভাবনা নাকি দুর্ভাবনা?

রাজেকুজ্জামান রতন:
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা গম্ভীরমুখে রোগীর অবস্থা নিয়ে যখন আলোচনা করতে থাকেন, রোগীর স্বজনরা সেসবের কিছুই না বুঝলেও একটা বিষয় বুঝতে চান, রোগী বাঁচবে তো? তেমনি বাজেট নিয়ে গুরুগম্ভীর নানা আলোচনা না বুঝলেও সাধারণ মানুষ বুঝতে চান জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে কি? মাছ-মাংসের দাম বাড়ছে, তেল, চিনির দাম বাড়তি, বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধির আলোচনা চলছে, পেঁয়াজের দাম তিনচার গুণ আর মৌসুমেও চালের দাম তেমন না কমায় সাধারণ মানুষের সংসারের বাজেটে যখন টানাটানি তখন আলোচনায় আসছে জাতীয় বাজেট। এবারের বাজেট ঘোষিত হবে সম্ভবত ১ জুন ২০২৩। যদিও এর পোশাকি নাম বার্ষিক আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন বাস্তবে সাধারণ মানুষের কছে তা বাজেট নামেই পরিচিত। বাংলাদেশে এ বছর এমন এক সময়ে বাজেট ঘোষণা হচ্ছে, যখন দেশে চরম মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক সংকট চলছে, সেই সঙ্গে বছর শেষে হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন।

ইতিমধ্যেই জানা গেছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের উপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া হবে এমন প্রস্তাবনা ও পরামর্শসহ আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭.৬৪ লাখ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলা হচ্ছে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাজেটে শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আগামী অর্থবছরে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং এক্সটার্নাল সেক্টরের বিদ্যমান অস্থিরতা দূর করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ইতিমধ্যেই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে অর্থবছর মোট দেশজ প্রবৃদ্ধির হার ৭.৫% এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫% প্রাক্কলন করছে অর্থ বিভাগ। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের দেওয়া ঋণের বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ম্যাক্রো ইকোনমির স্ট্যাবিলিটির স্বার্থ বিবেচনা করে প্রায় সব ধরনের প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে। তাই নির্বাচনের আগে এটি সরকারের শেষ বাজেট হলেও অন্যান্য নির্বাচনী বছরের বাজেটের সঙ্গে নতুন বাজেটের মিল পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন অনেকেই। নতুন বাজেটে ম্যাক্রো ইকোনমি স্ট্যাবিলিটি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মূল্যস্ফীতিকে। এছাড়া, এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নয়ন, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ০.৫০% বাড়ানো, এক লাখ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি এবং সরকারি ঋণের সুদব্যয় জোগান নিশ্চিত করাকে আগামী অর্থবছরের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেছে অর্থ বিভাগ।

পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ৭.৬৪ লাখ কোটি টাকার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ থাকবে ২.৬৩ লাখ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারের পরিচালন ব্যয় খাতে বরাদ্দ হবে। উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বরাদ্দ থাকবে ১.৬৯ লাখ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ব্যয় হবে ৯৪,০০০ কোটি টাকা। বাজেটের বাকি ৫ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে পরিচালন খাতে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৪.৩১ লাখ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় ৭৭,০০০ কোটি টাকা, পণ্য ও সেবা ক্রয়ে ৪০,০০০ কোটি টাকা, ঋণের সুদ পরিশোধে ১.১০ লাখ কোটি টাকা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ১.১৮ লাখ কোটি টাকা এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনায় ১.০৫ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব থাকবে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৬ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের প্রাথমিক আকার ধরা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট দাঁড়াবে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণ করা হবে কোথা থেকে? এই ঘাটতি অর্থায়নের জোগান আসবে তিন জায়গা থেকে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে পাওয়ার প্রত্যাশা ১ লাখ কোটি টাকা, ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে আসবে ২৪ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব সঠিক হলে দেখা যাচ্ছে যে, আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি ঋণ নিতে হবে সরকারকে।

এতো গেল সরকারের কথা। দেশের মধ্যবিত্তরা অপেক্ষায় আছেন সামনের বাজেটে তাদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা আসে কি না, আয়করের সিলিং বাড়ানো হয় কি না, সেটা দেখার জন্য আবার আতঙ্কে আছেন শুল্ক-কর বাড়ানো হলে অনেক জিনিসের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে। সংসার খরচ যত বাড়বে আয় কি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে? সাধারণ মানুষের এই ভাবনার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরা তাদের বিশ্লেষণ থেকে মন্তব্য করছেন যে, অন্যসব বছরের তুলনায় এ বছরের বাজেট কিছুটা চ্যালেঞ্জের হয়ে উঠবে।

সামনেই নির্বাচন। ফলে একদিকে জাতীয় নির্বাচনের কথা বিবেচনায় রেখে জনতুষ্টির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তগুলো বাস্তবায়নেরও চাপ থাকবে। তাই এর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় আর প্রবৃদ্ধির ওপর কতটা গুরুত্ব দিতে পারবে, বাজেটে এর প্রতিফলন কতটা হবে তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে। কিন্তু চাইলেই তো সরকার হুট করে ভর্তুকি কমাতে পারবে না। আর ভর্তুকি দেওয়া হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। যদিও স্বস্তি কতটা আসে আর কতটা যায় দুর্নীতির জোয়ারে ভেসে তা নিয়ে বিতর্ক আছে তারপরও ভর্তুকি সরকারের জন্য একটা বাধ্যবাধকতা। ধারণা করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি পরিমাণের ভর্তুকির প্রস্তাব করা হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি সম্ভাব্য প্রস্তাব করা হবে নাকি এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বাজেটে ভর্তুকির পাশাপাশি সরকারের নেওয়া ঋণের সুদের পরিমাণও বাড়বে। আগামী বছরের জন্য ঋণের সুদ বাবদ বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হবে ২৭ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা প্রায় এক লাখ কোটির বেশি। চলতি অর্থবছরে সরকারের নেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৭৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিই ঋণের সুদের পরিমাণ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ। কিন্তু পুঞ্জীভূত ঋণের বোঝা যে বাড়ছে তা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

একটা বিষয় লক্ষ করার মতো যে, প্রতি বছরই সরকার রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, রাজস্ব আদায় হয় তার চেয়ে কম। ফলে সরকারের আয় যায় কমে। তার ওপর রয়েছে বাড়তি মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকটসহ নানা চাপ। এর মধ্যেও সরকারকে প্রতি বছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হয়, এবারও হবে। এবার আর একটি বিষয় মাথার ওপর খড়গের মতো ঝুলে থাকবে তা হলো আইএমএফের শর্তযুক্ত ঋণ। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কারও করতে হবে সরকারকে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের চাপে তো জনজীবন দিশেহারা। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকায় গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষকে আরও বেশি সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে এবং তার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শহরের গরিবদের জন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি না থাকলেও ১২২টির বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, যদিও এসবগুলো গরিব মানুষের জন্য নয়। যেমন সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের টাকাও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বাজেট নিয়ে এই আলোচনার মধ্যেই প্রতিবারের মতো এবারও অর্থনীতি সমিতি বলেছে বাংলাদেশের বাজেট ২০ লাখ কোটির বেশি করা সম্ভব। এবং বাজেটে বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তারা আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫০ বছরে কালোটাকা ও অর্থপাচারের পরিমাণ ১৪৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত কালোটাকার পরিমাণ ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, আর বিদেশে অর্থপাচারের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। তাদের হিসাব দেখলে মনে হয় কী বিপুল সম্ভাবনার দেশ এই বাংলাদেশ আবার টাকা পাচারের পরিসংখ্যান দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে, এ দেশ কি সম্পদ লুট আর টাকা পাচারের অভয়ারণ্য?

সাধারণ মানুষ বাজেট বুঝে না, কিন্তু তাদের জীবনে বাজেটের আঘাত বুঝে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ছে কিনা তা না বুঝলেও বুঝে কীভাবে এসব দুর্মূল্য হয়ে উঠছে। কৃষি আর কৃষক দেশকে বাঁচিয়ে রাখলেও তাদের বেঁচে থাকা যে কষ্টকর হয়ে উঠছে, এটা তারা হাড়েহাড়ে বুঝতে পারে। প্রতি বছর শ্রমবাজারে কাজের জন্য আসছে যে ২২ লাখ নতুন শ্রমিক তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বাজেট বক্তৃতায় কী কথা বলা হয় বা কী লেখা হয় তা তারা জানে না, কিন্তু ছুটে আসে কাজের সন্ধানে। দেড় কোটির ওপর বৃদ্ধ মানুষ তাদের অসহায়ত্ব দূর করার কী পথ নির্দেশ হবে বাজেটে তা কি তারা ভাবে? কিন্তু প্রত্যাশায় থাকে একটু শান্তিতে মরার। দ্রব্যমূল্যের লাগাম ছেড়ে দেওয়া, না টেনে ধরা হলো, বাজারে তার প্রভাব তো দেখে না গৃহিণী। শুধু দেখে দাম বাড়ছে আর তার সংসারের বাজেট মিলছে না।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

rratan.spb@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION