বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩০ পূর্বাহ্ন
জাকির হোসেন:
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৪ মে রাতে এমন একটি খবর আসে। এর আগে কয়েকটি গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছিল আরও কিছু নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আরও কিছু এ কারণে, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন র্যাবের ডিজিসহ ৭ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এরপর থেকে জল্পনা-কল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আরও কিছু নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জারি করা নতুন ভিসানীতি ঘোষণা এলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি বাংলাদেশিদের জন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা না অন্য কিছু। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশিদের জন্য কি অপমানের? না আনন্দের।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বহু দিন ধরেই কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়েছে। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিমালা ঘোষণা। আশা করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ আগামী নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। তার মানে হলো, একটি দেশের নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে পক্ষগুলো যুক্ত থাকে তারা সবাই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করলে এই নীতিমালার আওতায় পড়বে। যেখানে সরকারি দল বা বিরোধী দল বলে কথা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত আসছে, তা সরকারকে জানানো হয়েছে গত ৩ মে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা শোনা যায়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনাই করেছেন।
২৪ মে রাতে যুক্তরাষ্ট্রের একই নীতিমালা ঘোষণার পর রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়। প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা একে স্বাগত জানিয়েছে। একটি মজার বিষয়, একটি সিদ্ধান্ত যে সব পক্ষকে খুশি করতে পারে তা মিরাকলই বটে। শুধু মিরাকলই নয়, একপক্ষ অন্যপক্ষকে বলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষ দলকেই বেকায়দায় ফেলবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিমালায় সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত বিএনপির। কারণ তারা নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের পরে যে সহিংসতা চালিয়েছে সেটার জন্য ভিসা বিধিনিষেধ আসতে পারে। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেও বলেছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি জোরালো সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা করেছে সরকার। বিবৃতিতে আরও বলেছে, মার্কিন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের তথাকথিত ৩সি ধারা অনুযায়ী ভিসায় বিধিনিষেধের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ঘোষণাটি নজরে নিয়েছে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার স্বার্থে দেশের সব স্তরে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকারের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট থেকে মার্কিন এই ঘোষণাকে বিবেচনায় নিতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল জাতি, যার কয়েক দফায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এটি একটা বড় পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ, বিএনপি তো ভোট চুরির প্রক্রিয়াতে নেই।’ সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, তারই প্রতিফলন মার্কিন নতুন ভিসানীতি।
আর জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন ভিসানীতির উদ্দেশ্য বোঝা গেছে, তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং নির্বাচনটা যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। এ ব্যাপারে আমাদের দলও একমত।’
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ভিসানীতি ঘোষণার পরদিন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। পরে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনের অংশ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি বলেন, ‘আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) বিবৃতিতে যা দেখেছেন, তা বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী সবার জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, যে বক্তব্য তারা (যুক্তরাষ্ট্র) দিয়েছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেটা চাচ্ছেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) তাকে আরও জোরালোভাবে বলেছেন। আমাদের অঙ্গীকার এবং অবস্থান সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন করতে চাই। এটাকেই তারা সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভিব্যক্তিতে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি শুধু রাজনৈতিক অঙ্গন ও আগামী নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিষয়টি কি তাই? বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা নিয়ে কেউ যখন ধমক দেয় সেটা কী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য লজ্জার নয়? অপমানের নয়? ’৯০-এর গণআন্দোলনে এত রক্তক্ষয়, এত ত্যাগ তবে কেন? বিশ্বের বুকে সম্মানিত জাতি হিসেবে কেন আমরা টিকে থাকতে পারছি না। শুধু কী নির্বাচন ক্ষমতার মোহই আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে?
একটু হিসাব করে দেখি, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। দেশটি থেকে রেমিট্যান্সও আসে সর্বোচ্চ। যা প্রতি বছরই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৯৬৬ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। নতুন ভিসানীতির কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কমতে পারে প্রবাসী আয়। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। আমরা জানি, প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয়ের অন্যতম একটি খাত। প্রতি মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আসে প্রবাসী আয় থেকে। এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগেও প্রভাব ফেলবে এই ভিসানীতি। কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো অনুসরণ করে। ফলে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া থেকে বিনিয়োগ প্রবাহ কমে আসতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিটা আবার যদি একটু দেখি, সেখানে বলা হয়ছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে : ‘ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই নীতির অধীনে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে আমরা সক্ষম হব।’
নতুন এই নীতির আরেকটি দিক হচ্ছে, সরকার প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াবে। নির্বাচনী জালিয়াতির সংশ্লিষ্টতায় একে অন্যের যুক্তরাষ্ট্র গমনে বাধা সৃষ্টি করবে। কেননা সরকারের এই পক্ষগুলো নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকে। অতিসম্প্রতি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সদ্যসমাপ্ত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতি জারির কারণ কিছুটা হলেও বোঝা যাবে। এ ছাড়া গাইবান্ধার নির্বাচন বাতিল নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে তা ঠেকানোর কোনো উপায় অবশ্য প্রয়োজন ছিল। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতির ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে।
কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, নিষেধাজ্ঞা কোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সুখকর নয়। বৈশ্বিক মন্দার এ সময় বাণিজ্যপ্রবাহ সচল রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। আগামী নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতি ঘোষণা শুধু কোনো একটি পক্ষকে সুবিধা বা বেকায়দায় ফেলবে তা নয়, বরং বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে নতজানু করে রাখারও একটি প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীল আচরণ পারত এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখতে।
লেখকঃ সাংবাদিক
zakpol74@gmail.com