পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য :
‘তোমাদের বাপ বলছি, ভাই বলছি আমাকে ছেড়ে দাও। আল্লার দোহাই লাগে, ছেড়ে দাও।’
ঠিক এভাবেই বার বার মিনতি করেছেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের গৃহবধূ। কিন্তু তার কাতর চিৎকারে সাড়া দেয়নি স্থানীয় কিছু যুবক। স্বামীকে বেঁধে রেখে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানো হয়েছে সেই নারীর ওপর। তারা সেই ঘটনার ভিডিও করেছে এবং ঘটনার ৩২ দিন পর সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গতকাল ভাইরাল হয়েছে।
তারপর থেকেই শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। বিচারের দাবিতে সোচ্চার সবাই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই প্রতিবাদটা আসলে কতদিন থাকবে। তিন বা চারদিন, হয়তো আরেও কয়েকদিন, তারপর মানুষ ভুলে যাবে, অন্য ইস্যু সামনে চলে আসবে।
আপনাদের কি মনে আছে, গত মাসের শেষ সপ্তাহে খাগড়াছড়িতে চাকমা সম্প্রদায়ের তরুণী ধর্ষণের ঘটনা? খোঁজ রেখেছেন সেই ঘটনার তদন্তে অগ্রগতি কতটুকু হলো?
নোয়াখালীর ঘটনার পর আজ এবং কাল কিছু প্রতিবাদ সমাবেশ হবে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রেসক্লাবের সামনে। কিন্তু কোথাও মানুষের বিশাল উপস্থিতি হবে না, কারণ আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের মানবিকতা সবকিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রিক।
আবার প্রতিবাদের ফল কি হয় সেটিও আমাদের অজানা নয়। গত সোমবার ধর্ষণবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার সময় ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে আটক করে থানা নিয়ে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠেছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। গ্রাফিতি আঁকার মাধ্যমে প্রতিবাদের চাইতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ভাষা আর কি হতে পারে?
কেউ কেউ আবার ক্রসফায়ারের দাবি জানাচ্ছে। সেটিও একটি অপরাধকে আরেকটি অপরাধের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে চাওয়া। ক্রসফায়ারে বিচার হলে ওই ছেলেগুলোর প্রশ্রয়দাতাকেই বাঁচিয়ে দেওয়া হবে।
অবশ্য স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়াতে যে তারা চিহ্নিত হবে কিংবা বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আসবে, সেটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না।
আবার যারা সবাই এই ঘটনার জন্য প্রতিবাদ করছেন, বিচার চাইছেন, তাদের অনেকের মানসিকতাও নোয়াখালীর যুবকদের মতোই, শুধু সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য কিংবা নিজেকে ভালমানুষ প্রমাণ করার এই সুযোগটা হাতছাড়া না করতে অনেকে প্রতিবাদ করছেন।
এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেই। সম্প্রতি সিলেটে এমসি কলেজে ছাত্রলীগ কর্মীদের গৃহবধূকে গণর্ধষণের ঘটনার পর ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি সবুজ আল সাহবা তার ফেসবুকে দুটি স্ট্যাটাস দেয়। ‘কিছু বেজন্মাদের কারণে পুরো ছাত্রলীগটাই কলুষিত হচ্ছে। কোন ব্যক্তির অপকর্মের কালিমা কোন সংগঠনের একার নয়।’ এবং অন্যটি ছিল, ‘ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ারে দিলে সমস্যা কোথায়? মাননীয় আইজিপি মহাদয়।’
কিন্তু সেই সাহবাকেই পুলিশ গৃহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ২ অক্টোবর।
একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে, ২ সেপ্টেম্বর রাতে বেগমগঞ্জের গৃহবধূ এত বড় নির্যাতনের পরও এতদিন থানায় কেন অভিযোগ জানালেন না বা তার পিতা কেন শুধু আল্লাহর কাছেই বিচার চাইলেন।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি থানায় মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে গিয়ে কি পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল মেয়েটিকে।
আপনাদের মনে আছে, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের কথা। সেই হত্যাকাণ্ডের পর অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল দেশব্যাপী।
গত ২০ মার্চ সেই হত্যাকাণ্ডের চার বছর পূর্ণ হয়েছে কিন্তু তদন্তে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি, বিচার তো অনেক দূরের কথা। তনুর বাবা ইয়ার হোসেন এখন আল্লাহর কাছে বিচার চান।
এগুলো প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা নয় কি?
একজন ভুক্তভোগীর এই আস্থাহীনতার পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় বিচার এবং শাস্তির হার খুবই কম। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়।
ধর্ষণের ঘটনায় ৮০ শতাংশেরও বেশি মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপসরফা হয়ে যায় ভয়ে কিংবা চাপে। ধর্ষণ মামলার মাত্র তিন শতাংশ ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়।
তাছাড়া আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ধর্ষণের শিকার নারীকেই প্রমাণ করতে হয় অপরাধটা তার ওপর সংঘটিত হয়েছে। পাশাপাশি ধর্ষণের দায় নারীদের ওপর চাপানো হয় বলে নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেকেই চুপ থাকেন, মামলা করেন না।
বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, গত ৯ মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন নারী। এ ছাড়া, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন আর আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। অপরদিকে, গত ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী।
এরমধ্যে কয়টির প্রতিবাদ হয়েছে, কয়টি ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে?
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্বকে খাটো করে দেখছি না একবারেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং প্রভাব তৈরির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে এই মাধ্যমের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণেই আমরা অন্তত অনেক কিছু জানতে পারছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনকে সঠিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
আবার কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে বেশী মাতামাতি হলে তার মধ্যে অবশ্যম্ভাবীভাবে রাজনীতিও চলে আসবে, পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হবে।
কোনো পক্ষ অভিযোগ তুলবে- এটি একদলীয় রাজনীতির ফল আবার অন্যপক্ষ থেকে অপরাধীর কোনো দল নেই, ধর্ম নেই, অনুপ্রবেশকারী এমন কিছু বাক্য বিনিময় হবে আগামী কয়েকদিন। তারপর আবার সবকিছু সবাই ভুলে যাবে, নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই আসলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েই... সে হোক প্রতিবাদ কিংবা মানবিকতা প্রদর্শন.. আমাদের মহান দায়িত্ব পালন করছি! আমরা সবাই নিজেকে বাঁচিয়ে চলার এক আশ্চর্য কৌশল রপ্ত করে ফেলেছি।
কিছুদিন আগে কলকাতার অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের লেখা কবিতা ছোট্ট এক ছেলে বিতান রাউতের কণ্ঠে খুব ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মনে আছে? কয়েকটা লাইন মনে করিয়ে দিচ্ছি।
‘দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না।
যে যা করে দেখি ভাই, সুবিধেটা নিয়ে যাই,
দুম করে প্রকাশ্যে আসি না।
রাজনীতি, দলাদলি কিংবা সে কোলাকুলি,
যে যা খুশি হয়ে যাক, দুনিয়া চুলোয় যাক।
আমি টু শব্দটি করি না, বারান্দা থেকে আমি নামি না।’
আমাদের সবার না হলেও বেশীরভাগই এখন এই মানসিকতা ধারণ করছি। নিজের দিকে তীর না আসা পর্যন্ত আমরা নিজেকে কোনো বিপদে জড়াতে চাইছি না আর। কিন্তু কথায় বলে- নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। জার্মান কবি মার্টিন নিম্যোলার-এর ‘ফার্স্ট দে কেম’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি দিয়ে লেখাটা শেষ করছি।
‘যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল,
আমি কোনো কথা বলিনি, কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,
আমি নীরব ছিলাম, কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম, কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি, কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।’
পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য, চিফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
partha.pratim@thedailystar.net
ভয়েস/জেইউ।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.