আনিস আলমগীর:
কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য র্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে নানা রকম তালবাহানা, বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় বেসরকারি সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত একটি টেস্ট কিটের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষ অসহযোগিতা করছে এমন অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিতর্কে যুক্ত হয়ে পড়েছেন ডাক্তার-আমলা-রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও। র্যাপিড টেস্ট কিট মানে হচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে শরীরে করোনাভাইরাস আছে কি নেই সেটা জেনে নেওয়া। বর্তমানে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মাধ্যমে করোনার যে পরীক্ষা হচ্ছে সেটাতে এই দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও র্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে, কারণ এতে শতভাগ সঠিক ফলাফল নাও আসতে পারে। সেই মোতাবেক বাংলাদেশ সরকারও শুরু থেকে র্যাপিড টেস্ট নিয়ে ইতিবাচক নয়। কিন্তু র্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে আমাদের মতো গরিব এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশের এই মনোভাব দেখানো কতটা সঠিক হচ্ছে—সেটা ভাবতে হবে। কারণ আমরা প্রযোজনের তুলনায় অতি সামান্য সংখ্যক লোকের কোভিড-১৯ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারছি। পর্যাপ্ত ল্যাব, কিটও আমাদের নেই। ৪ মে ২০২০ স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য বুলেটিন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছে সর্বমোট ৮৭ হাজার ৬৪১ জনের। ১৭ কোটি মানুষের দেশে এখনও এক লাখ লোকের দেহে করোনা আছে কি নেই পরীক্ষা করতে পারিনি আমরা। দিনে এখনও ১০ হাজার রোগীর পরীক্ষা করার সক্ষমতা নেই। পরীক্ষার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ৪ মে শাহবাগে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
অথচ ডাক্তার-বায়োকেমিস্টরা বলছেন, কোনও টেস্ট কিটই সীমাবদ্ধতার বাইরে নয়। সেটি র্যাপিড টেস্ট হোক অথবা আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে হোক। ঢাকায় এক তরুণ ব্যাংকারের কথাই ধরি। তাকে তো পিসিআর পদ্ধতিতে দুইবার পরীক্ষা করার পরও ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। শেষবারে যখন পজিটিভ এলো, চিকিৎসা শুরু করতে না করতেই মারা গেলেন। সুতরাং সরাসরি সেবা প্রদানকারী ডাক্তার, নার্স ছাড়াও যারা জরুরি সেবা দিচ্ছে এমন সেনাবাহিনী, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যাংকার, স্বেচ্ছাসেবকসহ যেকোনও বিভাগ, সংস্থা বা ব্যক্তিকে কোভিড-১৯ থেকে দূরে রাখতে পারে র্যাপিড টেস্ট কিট। এই ধরনের কিট রোগীর উপসর্গের সঙ্গে মিলিয়ে পজিটিভ ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে অন্য রোগী থেকে আলাদা করে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার পক্ষে সহায়ক।
গণস্বাস্থ্য বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান, যারা এই কিটের বাজারজাত করতে আগ্রহী, তাদের উদ্যোগকে স্বার্থ সংঘাতের বাইরে গিয়ে, আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে না ফেলে ট্রায়ালের মাধ্যমে দ্রুত যাচাই করে দেখতে হবে। ওষুধ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য ছাড়া এরকম আরও চারটি প্রতিষ্ঠানের র্যাপিড টেস্ট কিটের অনুমতি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি সেটা নিয়ে বসে আছেন কেন! এই মুহূর্তে তিনি তো এটা ধরে রাখতে পারেন না। তাকে অবশ্যই হ্যাঁ-না সিদ্ধান্ত দিতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। তাহলে যারা আবেদন করেছেন তারা দ্বিতীয় চিন্তা করতে পারেন। ব্যবসার অনুমতি পেলে সেটা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। ত্রাণের চালের বস্তা রেখে দিয়েছেন বলে চেয়ারম্যান জেলে যান, ইউএনও’র চাকরি যায়, তিনি কি আইনের ঊর্ধ্বে? কালক্ষেপণের জন্য তার অফিসের কি কোনও জবাবদিহিতা নেই? নাকি জাফরউল্লাহ ভিন্ন শিবিরের রাজনীতি করেন বলে তিনি এসব হয়রানি, আমলাতান্ত্রিক ‘হাইকোর্ট দেখানোর’ সুযোগ নিচ্ছেন? শেষ পর্যন্ত তো তিনি ঠিকই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে গণস্বাস্থ্যের কিট পরীক্ষা করতে দিলেন, তাহলে আরও আগে দিলে কী সমস্যা হতো!
আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা জানুয়ারি থেকে শুরু করে পুরো তিন মাস সময়কে কাজে লাগাতে পারেননি। বরং প্রস্তুতি আছে বলে জনগণের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন। সরকারকে বিব্রত করেছেন। আমাদের সময় ব্যয় করার সময় এখন নেই। দ্রুত কাজের পরিবেশ তৈরি করা, অর্থনীতির চাকাকে ঘুরানোর জন্য আমাদের ম্যাসিভ টেস্টে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরীক্ষা না করলে আমরা জানবো কি করে কত লোক এখনও আক্রান্ত, কবে লকডাউন পুরোপুরি তুলতে পারবো, কবে কাজকর্ম শুরু করবো! সরকার ১০ মে থেকে সীমিত আকারে দোকানপাট খোলারও অনুমতি দিয়েছে। সামনে ঈদ আসছে। মানুষের ঈদের কেনাকাটা আছে। জীবনযাত্রা তো অনন্তকাল থামিয়ে রাখা যাবে না। আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে সরকারি হিসাবে। কোথায় থামবে কে জানে!
বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী শুধু চলবে নাকি নিজস্ব আর্থসামাজিক, শ্রমঘন পরিবেশ বিবেচনা করে র্যাপিড টেস্ট কিটের দিকেও যাবে, সেই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ডব্লিউএইচও বাধা দিচ্ছে তাও নয়, দেশগুলোকে নিজস্ব চিন্তাধারা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের বাধা আছে বলে শুনিনি।
সেনেগালের ঘটনা তো বিস্ময়কর। আল জাজিরা রিপোর্ট করেছে করোনা থাক না থাক প্রত্যেক নাগরিক এক ডলার মূল্যের র্যাপিড টেস্ট কিট দিয়ে পরীক্ষা করে জেনে নিচ্ছে। প্রেগন্যান্সি টেস্ট করার মতোই সহজ এবং কম সময়ে ব্যবস্থা করেছে তারা। চমৎকারভাবে তারা নিজস্ব উদ্যোগে দেশের সব নাগরিকের টেস্ট করতে পারছে। ৪ মে পর্যন্ত সেখানে আক্রান্ত ধরা পড়েছে ১ হাজার ১৮২ জন, সুস্থ হয়েছে ৩৭২ জন আর মৃতের সংখ্যা ৯ জন। ৬ কোটি জনগণের জন্য তাদের পর্যাপ্ত কিট তো আছেই বরং মিলিয়ন মিলিয়ন কিট তৈরি করে সহযোগিতা করছে আফ্রিকান অন্যান্য দেশকে। ১৬ হাজার ডলারের বিদেশি ভেনটিলেটরের কাজ সারাচ্ছে তারা মাত্র ৬০ ডলারে তৈরি দেশীয় যন্ত্র দিয়ে।
অথচ আমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের নিরুৎসাহিত করছি। আবার টেস্টের ক্ষেত্রেও পৃথিবীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশের তালিকায় আছি। আমাদের করোনা রোগীর মৃত্যুহারও আতঙ্কজনক।
ডাক্তার জাফরুল্লাহ তো আশাবাদী যে তাদের কিট ৯৫ ভাগ সঠিক রেজাল্ট দেবে। ধরে নিলাম সেটা আরও কম, ৮০ ভাগ সঠিক রেজাল্ট দেবে। সমস্যা কী! যারা টেস্ট করে সঠিক রেজাল্ট পায়নি সেই ২০ শতাংশ লোকের রোগের লক্ষণ অব্যাহত থাকলে আরও ২/৩ বার করবে। পরের বারতো আরও ৮০ শতাংশ মানে ১৬ ভাগ সঠিক রেজাল্ট পাবে। বাকি থাকলো মাত্র ৪ শতাংশ। দ্রুত এবং সস্তায় কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য এই পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তো বিকল্প দেখছি না। আর এই পরীক্ষা তো শুধু একবার না, বারবার করতে হবে। যারা এখন আক্রান্ত হয়েছেন তারাও আবার করতে হতে পারে এবং দ্রুত এই মহামারি থেকে আমরা রেহাইও পাচ্ছি না। হয়তো দেশের সিংহভাগ লোককে এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা করোনা নেগেটিভ সনদ চাইবেন। গ্রামগঞ্জের সবার পক্ষে কি করে সম্ভব এই পরীক্ষার জন্য ঢাকায় আসা!
করোনার টেস্ট আমরা তো শুরুতে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শুরু করেছিলাম। স্ক্যানার দিয়ে আমরা গায়ে তাপমাত্রা কম না বেশি তা দেখে রোগী সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছি। অনির্ভরযোগ্য হলেও সেটাকে আমরা মেনে নিয়েছি। এখনও আমরা র্যাপিড টেস্ট নিয়ে ব্যুরোক্রেটিক ফিতা প্যাঁচানো বাদ দিয়ে তাকে দ্রুত স্বাগত জানাতে পারি। আমাদের ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটি চালু করতে হলে ঘরে বসে থাকলে হবে না। আমাদের যুবক শ্রেণিকে কাজে উৎসাহ দিতে হবে বেশি, কারণ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তারা অগ্রগামী থাকবে। কিন্তু তার জন্য ডব্লিউএইচও’র ভাষায় তো সেই কথাই আসছে—টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট।
এদিকে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ায় কিছু লোক সমালোচনা করছেন, বাণিজ্যিকীকরণ রোধে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে আইনি নোটিশও পাঠিয়েছেন সরকারকে। তাদের যুক্তি নির্ধারিত ৩৫শ’ টাকা ফি সবাই দিতে পারবে না। যারা এর বিরোধিতা করছেন তারা না বুঝে করছেন। আমি সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই এবং এটা আরও আগে নেওয়া হলে হাজার হাজার রোগীকে নানা অসুখ নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে হতো না। বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আসতো। কিসের রোগী সেটাই যদি তারা নিশ্চিত হতে না পারে, তবে চিকিৎসা শুরু করবে কী করে! করোনায় আক্রান্ত নয় নিশ্চিত হলে তাকে দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারে। এমন কি করোনার রোগী হলেও চাইলে তাদের আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পারতো তারা। সংক্রমণের ভয় থাকতো না।
এখন বড় লোক, মধ্যবিত্ত চাইলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ নিতে পারবে। হাসপাতাল মালিকরাও পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়ে নিজস্ব অর্থায়নে আরটিপিসিআর স্থাপন করবে এবং পরীক্ষা করতে থাকবে। অনেক যন্ত্রপাতি তাদের অলরেডি আছে এবং নতুন করে পিসিআর বসালে সেটা তাদের অন্যান্য পরীক্ষার কাজেও লাগবে। বাংলাদেশে ৬৩টি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ আছে। তারাও তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এমন ল্যাব বসাতে পারে।
মানুষের জীবনের মূল্য টাকার কাছে তুচ্ছ। এখন তো টাকা থাকলেও পরীক্ষা করতে পারছে না অনেকে। কোথায় যাবে, কতক্ষণ অপেক্ষা করবে—এসব ভেবেই তো অসহায় হয়ে পড়েছে মানুষ। আইইডিসিআর বলছে এখন থেকে আর নমুনা সংগ্রহ করবে না। করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে হবে। সেই তত্ত্বাবধান আসলে কী এখনও বুঝে আসছে না। সবাইকে বেসরকারি হাসপাতালে ঠেলে দেওয়া যদি উদ্দেশ্য হয় সেটা অন্যায় হবে।
সবশেষে বলতে হয়, পরীক্ষা একবার না হলে বারবার করা যাবে। এই পরীক্ষাও শেষ পরীক্ষা না, এসব র্যাপিড টেস্ট কিটও চূড়ান্ত না। আমাদের দিশেহারা অবস্থা কাটানোর জন্য আপাতত এগুলো দিয়ে কাজ চালালেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজারেও চলে আসবে আরও নির্ভরযোগ্য কোয়ালিটি টেস্ট কিট।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.