ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
অনুং প্রু মারমা ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। বয়স ২০ কী ২১। অগ্রণী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের বান্দরবান শাখায় তার নামে তিনটি হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে গত পাঁচ মাসে অস্বাভাবিক লেনদেন ধরা পড়েছে। এর মধ্যে কেবল অগ্রণী ব্যাংকেই গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে জমা হয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তার বাবা আথোয়াই মং মারমা চট্টগ্রামের হালিশহর সিএসডি খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক।
বিপুল নগদ অর্থের মালিক হওয়ার পাশাপাশি বান্দরবান জেলার লামা থানার সামনের ছয়তলা বাড়িটির মালিকও আথোয়াই মং মারমা। ১০ গন্ডা জায়গার ওপর ভবনটির সামনে আরও একটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। এ ভবনের নিচতলায় বাংলাদেশ পুলিশের লামা সার্কেল (লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি) কার্যালয়। সেটি আথোয়াই মং মারমা পুলিশকে ভাড়া দেওয়ার কারণে খোদ বান্দরবান শহরেই তার আলাদা দাপট।
এর মধ্যে অনুং প্রু মারমার নামে সোনালী ব্যাংকের ২০১৮ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেনদেনের একটি হিসাব আমাদের সময়ের হাতে এসেছে। ওই চার মাসে ব্যাংকে টাকা জমা ও তোলার বর্ণনা থেকে দেখা যায়, ব্যাংকটির বান্দরবান শাখায় লেনদেন হয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার ৭৩৪ টাকা। একই সময়ে অগ্রণী ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৪১৫ টাকা। পূবালী ব্যাংকেরও একটি হিসাব রয়েছে একই নামে। সেখানে গত তিন মাসে আড়াই কোটি টাকা লেনদেনের খবর পাওয়া গেছে।
অগ্রণী ব্যাংকের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ হিসাবে সবচেয়ে বেশি টাকা জমা পড়েছে ইএফটি ওয়ার্ড ভিশন নামের একটি হিসাব থেকে। সেখানে ৭ এপ্রিল ১০ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ১০ মে ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ১ জুন ১০ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭২ টাকা, ১২ জুলাই ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ১২ জুলাই ৪১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, ২ সেপ্টেম্বর ১০ লাখ ১৬ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এর বাইরে আরটিজিএস নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এ চার মাসের বিভিন্ন তারিখে জমা হয়েছে ৭৬ লাখ টাকা। এসব টাকার বেশিরভাগই জমা পড়েছে কক্সবাজার থেকে।
তিন ব্যাংকেরই লেনদেনের কথা স্বীকার করে হালিশহর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক আথোয়াই মং মারমা আমাদের সময়কে বলেন, আমার ছেলে কলেজে পড়ে। করোনাকালে সারাক্ষণ বাসাতেই থাকে। সে এ সবের কিছুতেই নেই। বিষয়গুলো আমি দেখাশোনা করি। এত টাকা কোত্থেকে আসে? এমন প্রশ্নে আথোয়াই মং বলেন, বান্দরবানের কিছু ঠিকাদার এই হিসাবগুলোয় টাকা রাখে। পাহাড়ি কোটা ব্যবহার করে ঠিকাদারি কাজ করলে কর মওকুফের সুবিধা আছে। সে জন্য তারা এটা করে। কর মওকুফের জন্য তো নিজেদের ব্যাংক হিসাবেই টাকা রাখবে। আপনার কাছে রাখার দরকার কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওসব বাদ দেন। আমাকে সহযোগিতা করুন।
কারা এই ঠিকাদার জানতে চাইলে আথোয়াই মং আর তাদের নাম বলতে পারেননি। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টা আসলে আমারই দোষ।
তবে ছেলে অনুং প্রু মারমার ফেসবুক ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যদিও সেখানে বিস্তারিত লেখা নেই।
ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছেলে অনুং প্রু মারমার নামে হিসাব খোলা হলেও মূলত টাকা তোলার কাজটি আথোয়াই মং মারমা নিজেই করে থাকেন। স্বাক্ষরও করেন তিনি নিজে।
ব্যাংকের লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে এ তিনটি হিসাবে টাকা এসেছে প্রতি মাসে। সোনালী ব্যাংকের ২০১৮ সালের ৬ মাসের হিসাব থেকে দেখা যায়, ওই বছরের ২৩ জুন আলীকদম থেকে তার সোনালী ব্যাংকের হিসাবে জমা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। ২৪ জুন লামা থেকে জমা হয়েছে ২ লাখ টাকা। ২৮ জুন কক্সবাজার থেকে যোগ হয়েছে ৪ লাখ টাকা। ২ জুলাই কক্সবাজার জেলার রামু থেকে জমা হয়েছে ১৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। একই দিনে চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী এলাকা থেকে ১৬ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭০ টাকা এবং ৪ জুলাই পাহাড়তলী থেকে ৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৫ টাকা জমা হয়েছে। আবার ৩ আগস্ট আলীকদম থেকে ১১ লাখ টাকা, ১৯ আগস্ট ১৫ লাখ টাকা, ২২ আগস্ট কক্সবাজার থেকে ২০ লাখ টাকা এ ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। সেপ্টেম্বরে আলীকদম থেকে তিন দাগে মোট ২৫ লাখ টাকা জমা হয়েছে। চন্দ্রঘোনা থেকে জমা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। ২৭ সেপ্টেম্বর লামা থেকে জমা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। প্রশ্ন উঠেছে, চট্টগ্রামে চাকরি করার পরও কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কীভাবে এত টাকা জমা হয়?
গত বছরের ১৬ অক্টোবর আথোয়াই মং মারমা চট্টগ্রামের হালিশহর সিএসডি খাদ্য গুদামের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। এর এক মাসের মধ্যেই তিনি ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হিসেবে সেখানকার ছয় উপজেলার খাদ্য গুদামের কর্তৃত্ব নিয়ে নেন। তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় ব্যবস্থাপক হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক হয়েই তিনি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তার প্রতি সদয় থাকেন।
মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমনের পর থেকেই তিনি খাদ্য বিভাগে আলাদীনের চেরাগের খোঁজ পান। নিয়ম অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ সব চাল সরকারের গুদামে রেখে পরে সেখান থেকে সরবরাহ করতে হয়। কিন্তু আথোয়াই মং মারমা কোনো চাল গুদামে না এনেই সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দেন। এখানকার টাকাগুলো জমা দিতেই আথোয়াই মং ২০১৭ সালে সোনালী, অগ্রণী ও পূবালী ব্যাংকে ছেলের নামে তিনটি ব্যাংক হিসাব খোলেন। অথচ সে সময় ছেলেটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গ-ি পার হয়নি।
ব্যাংক হিসেবে বিপুল অর্থ ছাড়াও ছেলে অনুং প্রু মারমার নামে বান্দরবানে এএনপি এন্টারপ্রাইজ ও চৌধুরী অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। এএনপির নামে বান্দরবান মধ্যমপাড়ায় চালের বড় ব্যবসা আছে। চৌধুরী অ্যান্ড ব্রাদার্সের নামে আছে ট্রাকের ব্যবসা।
কী ধরনের দুর্নীতি করে এত বিপুল বিত্তের মালিক হন আথোয়াই মং মারমা? এ প্রশ্নের জবাব তার সহকর্মীদেরও অজানা। তবে নাম প্রকাশ না করে একাধিক সহকর্মী বলেন, তিনি কক্সবাজার, বান্দরবান ও আশপাশের এলাকায় সরকারি গুদাম থেকে খাদ্য সরবরাহের মূল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এক কর্মস্থলে বেশিদিন থাকেন না। ফলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাকাপাকি হওয়ার আগেই তিনি অন্য জায়গায় স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে যান। ফলে আগের কোনো সহকর্মী তার বিরুদ্ধে আর লেগে থাকেন না। সূত্র:আমাদের সময়।
ভয়েস/জেইউ।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.