রুমিন ফারহানা:
সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি। ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আমাদের চেম্বারের ক্লার্ক ইমরানের দুটো মিসড কল। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না কী ঘটেছে। দুদিন আগেই আদ-দ্বীন হাসপাতালে গিয়েছিলাম আমি।
দূর থেকে দেখা হয়েছে আমাদের। এই প্রথম একপক্ষীয় দেখা। সেদিনই বুঝেছিলাম, ২০১২ সালের ২০ অক্টোবরের পর আবারও অভিভাবকহারা হতে যাচ্ছি আমি। ইমরানকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম দুপুর ২টায় হাইকোর্টে নামাজে জানাজা হবে তার। ২টার বেশ আগেই কোর্টে পৌঁছে দেখি বহু মানুষ আগেই সমবেত হয়েছে তাকে নিয়ে আসার অপেক্ষায়।
জানাজা আরম্ভ হতেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। আমি দূরে দাঁড়িয়ে ভিজছি একা। চোখে ভাসছে একটার পর একটা দৃশ্য। ২০০৫ সালের অক্টোবরের এক হিমেল সন্ধ্যায় মাত্রই ব্যারিস্টারি পাস করে আসা সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া আমি মহীরুহের মতো বিশাল এই মানুষটির চেম্বারে প্রথম পা রাখি।
বিশাল একটি ঘর মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বইয়ে ঠাসা। ঘরের মাঝখানে বড় একটা সেন্টার টেবিল ফাইল দিয়ে ঘেরা। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে গভীর মনোযোগে জুনিয়রের তৈরি করে দেওয়া পিটিশন সংশোধন করছেন তিনি। এক হাতে ধরা লাল কলম।
প্রায় এক মাস পর আমাকে তিনি প্রথম কাজ দেন। একটি মানহানি মামলায় একজন বিখ্যাত মানুষের পক্ষে একটি ড্রাফট লেখার জন্য। লিখে দিলাম সেটি। প্রথম কাজটি তার এতই পছন্দ হয় যে তিনি সেই ড্রাফট তার সঙ্গে কাজ করা অনেক আইনজীবীকে নিজে দেখিয়েছিলেন। আপাদমস্তক একজন প্রফেশনাল মানুষ রফিক-উল হক স্যারের সঙ্গে এভাবেই সম্পর্ক তৈরি হয় কাজের সূত্রে। পরে সেটা কাজকে ছাড়িয়ে যায় বহুদূর, পায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপ্তি।
দেশের এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়, ওয়ান ইলেভেনে স্যারের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি আমি। সে সময় দেখেছি এই একজন মানুষ কীভাবে একটা প্রবল পরাক্রমশালী সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমার বাবা অলি আহাদ প্রথম কোনো রাজনীতিবিদ হিসেবে ওয়ান ইলেভেনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ায় বাবার প্রতি ভীষণ
কৃতজ্ঞ ছিলেন স্যার।
কোনো একটা মামলা নিয়ে আমার বাবার সঙ্গে স্যারের গভীর মনোমালিন্য তৈরি হয়; সেই সূত্রেই তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল না একেবারেই। কিন্তু সেটাও স্যারের চেম্বারে অলি আহাদের মেয়ের কাজ করার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্রও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক যেমনই থাকুক না কেন একজন রাজনীতিবিদ অলি আহাদ সম্পর্কে ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা, যেটা তিনি সবার সামনে প্রকাশ করতে কখনোই কার্পণ্য করতেন না। বাবা অসুস্থ হলে প্রথমেই দেখতে আসেন তিনি, মৃত্যুর সময়ও তাই। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে দূরে রেখে মানুষকে তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারা ছিল তার চরিত্রের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য।
রফিক-উল হক স্যারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ পথচলায় যে জিনিসটি গভীরভাবে লক্ষ করেছি এবং সত্যি বলতে কী, যা আর কারও মধ্যে আমি পাইনি তা হলো পিটিশনের টেমপ্লেইট-এর প্রতিটি শব্দ থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ পিটিশনের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত সবকিছু চেক করতেন তিনি। ‘বদরাগী’ হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। যখন যে জুনিয়রের পিটিশন নিয়ে বসতেন সেই জুনিয়র সে সময়টুকু প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে থাকত। স্পষ্ট চোখে ভাসে আমার পিটিশন পড়ছেন উনি, আমি এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি চোরের মতো। বকা আবার সাক্ষী ছাড়া স্যার দিতে পারতেন না। আর বেশিরভাগ সময়ই দেখা যেত সাক্ষী হচ্ছে সেই মামলার মক্কেল। নিজের মেয়ে ছিল না বলেই হয়তো-বা ভীষণ স্নেহ করতেন আমাকে। ডাকতেন ‘মেমসাহেব’ বলে।
প্রচণ্ড রাগী বলে পরিচিত এই মানুষটির কাছাকাছি যারা গেছেন তারা জানেন রাগের আড়ালে কী ভীষণ কোমল একটা হৃদয় ছিল তার। আমরা জুনিয়ররা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম ‘সব সমস্যা চেম্বারের ওই ঘরটা আর কোর্টের– ওখানে গেলেই স্যার বদলে যান’। স্যার, চাচি (ডা. ফরিদা হক) আর ফাহিম ভাইয়ের (স্যারের একমাত্র সন্তান ব্যারিস্টার ফাহিম-উল হক) ছোট্ট পরিবারটির বাইরেও বৃহৎ এক পরিবারের কর্তা ছিলেন তিনি। তার প্রতিটি জুনিয়র ছিল তার সন্তানতুল্য। প্রাচীনকালে গুরু যেভাবে নিজ সন্তানের মতো তার শিষ্যদের তৈরি করতেন, তিনি ছিলেন ঠিক তেমন। যেমন শাসন, তেমনি স্নেহ।
তার স্নেহের একটা বড় প্রকাশ আমরা দেখতাম যখন ছোট্ট পরিবারের সঙ্গে আমরা যার যার পরিবারসহ যুক্ত হয়ে একটা বড় পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতাম। বেশিরভাগ সময়ই যাওয়া হতো যমুনা রিসোর্টে। তখন স্যারের ভিন্ন রূপ যার যেভাবে খুশি আনন্দ করো, যত ইচ্ছে ঘোরাঘুরি, যা ইচ্ছে খাও। স্যারকে তখন কেউ ভয় পেতাম না আমরা। আমাদের খুশি দেখেই শিশুর মতো খুশি থাকতেন তিনি। এমনকি মামলার কাজে যখন তার সঙ্গে বিদেশ গেছি, তখনো খুশি থাকতেন তিনি। ওয়ান ইলেভেনের সময় মামলা নিয়ে বেশ ক’বার থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই যেতে হয়েছে তার সঙ্গে। কলকাতা নিয়ে গিয়েছিলেন তার আদি বাড়ি দেখাতে। তার হাত ধরেই আমার প্রথম শান্তিনিকেতন দেখা। এমনকি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে শুরু করে কফি হাউজ পর্যন্ত ঘুরেছি তার হাত ধরে। ওই বয়সে একেবারে শাসনহীন, বাঁধনহীন বেড়ানোর সুযোগ আমার ছিল না বাবা-মায়ের সঙ্গে, কিন্তু স্যারের কাছে ছিল অসীম প্রশ্রয়। আমরা যারা উদয়াস্ত কোর্ট আর চেম্বারে পরিশ্রম করতাম তাদের জন্য স্যারের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ছিল ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’। পরে শুনেছি বহু আগে থেকেই নাকি এটাই এই চেম্বারের রেওয়াজ।
স্যারের উইট ছিল অসাধারণ। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে একবার সিঙ্গাপুরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় ফুটপাত একটু উঁচু-নিচু দেখে তার নিরাপত্তার কথা ভেবে তার হাত ধরতে চাইলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। সেদিন কেন যেন উনার হাতটা বেশ ঠান্ডা ছিল। বলেছিলাম, স্যার হাত এত ঠান্ডা কেন? চটপট জবাব তার মাথাটা অনেক বেশি গরম, তাই হাত এত ঠান্ডা ।
সময় কেটে যায়, প্রত্যেকেরই তার তার মতো ব্যস্ততা তৈরি হয়। এক সময় স্যারের চেম্বার থেকে অন্য চেম্বারে যাই, তারপর একসময় রাজনীতির চাপে প্র্যাকটিস থেকেই অনেকটা সরে আসি। কিন্তু স্যারের সঙ্গে যোগাযোগটা রয়ে গিয়েছিল ফোনে এবং সরাসরি। মাঝে মাঝেই তাকে দেখতে চলে যেতাম তার বাসায়। মনে পড়ে, এমপি হওয়ার পর স্যারকে সালাম করতে গিয়েছিলাম। কী অসাধারণ খুশি হয়েছিলেন তিনি সেদিন।
সুস্থ থাকা অবস্থায় শেষ তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম গত ডিসেম্বরে। বহুদিন ধরেই দোতলা থেকে তেমন একটা নিচে চেম্বারে নামতেন না তিনি। নিজের ঘরে বসে বড় একটা স্ক্রিনে টিভি দেখতেন সারা দিন। শেষ কয়েক বছর ওই ঘরেই তার সঙ্গে দেখা হতো জুনিয়রদের। আমার সঙ্গে বলতেন দেশের কথা, রাজনীতির কথা। জানতে চাইতেন কেমন চলছে আমার চেম্বার। প্রতিবার দোয়া করতেন যেন অনেক বড় হই আমি। মাঝে মাঝে ফোন করতেন কিংবা খবর নিতে আমি ফোন করতাম তাকে। ফোন রাখার সময় একটা কথাই বলতেন প্রতিবার ‘কিরে আমাকে দেখতে আসবি না তুই’? নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়, শেষের দিকে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া মানুষটির কাছে হয়তো আরও অনেক বেশি যাওয়ার দরকার ছিল। তার কাছে অনেক ঋণ আমার। তাকে আমি বাবা ডাকতাম যে।
লেখক : ব্যারিস্টার ও সংসদ সদস্য
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.