সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:
আমরা যারা লালমনিরহাটের ঘটনা দেখে, কিছুটা প্রশাসনিক ও পুলিশি তৎপরতা দেখে ঘুমিয়ে ছিলাম, তারা জেগে উঠবার আগেই ওরা কুমিল্লার মুরাদনগরে ঘটনা ঘটিয়েছে। গুজব ছড়িয়ে হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ করা, জ্বালিয়ে দেওয়াসহ যা যা ওরা করে, সব করেছে।
‘ওরা’। এই ‘ওরা’ আসলে কারা? ‘ওরা’ তারা, যারা এই দেশটার বিরোধী। আমাদের অস্তিত্বকে নষ্ট করে দিতে চায় যারা। ওরা যতটা ভাঙছে, তার চেয়ে অনেক কম গড়ছে। ওরা প্রতিমুহূর্তে ভাঙছে। ওরা আমাদের একতা ভাঙছে, ওরা আমাদের চেতনা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, ওরা আমাদের শান্তি, স্থিতিশীলতা কেড়ে নিচ্ছে। তাই ওরা যখন বাড়ে, তখন আমাদের পরিধি ক্ষুদ্র হতে থাকে। ওরা এতটাই বিধ্বংসী যে, আমরা আমাদের নিজেদের বিচারবুদ্ধিও আমাদের হাতে রাখতে পারি না। কখনও কখনও আমরাও ওদের মতো ‘ওরা’ হয়ে হত্যার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাই বা হত্যা, রক্তপাত আর নারীর অপমানকে কোনও একটা যুক্তি দিয়ে জায়েজ করি।
কেন এমন হলো? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যায় না। আমরা ওদের অনেক ক্ষমা করেছি, অনেক উদাসীনতা দেখিয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের সর্বাত্মক হিংসার পথ থেকে কখনও সরে আসেনি। শাসক দলের চৌহদ্দিতে ঢুকে ওরা সেটাই করেছে, যেটা ওদের প্রয়োজন ছিল।
অনুপ্রবেশের গল্পটি পুরনো। কিন্তু দুই একটি তথাকথিত হুঁশিয়ারি ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন দলে থাকলে যা হয়, সুযোগ নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে। তাই ঝাঁকে ঝাঁকে লোক শাসক দলের পতাকা নিয়ে মিছিলে হাঁটে, বক্তৃতা দেয়। এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে, পাইয়ে দেওয়ার বা পেয়ে যাওয়ার ক্ষমতাটুকু পুরোটাই আসলে নিংড়ে নিচ্ছে ওরা। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে একাত্তরের সেই পুরনো শকুন।
কিন্তু এই যে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বা পেয়ে যাওয়ার রাজনীতি, এর শেষ কোথায়? এর কোনও শেষ নেই। ধর্মীয় মেরুকরণ? সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ? কোনোটারই শেষ নেই।
এটুকু দিয়ে পুরো জিনিসটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তার চেয়ে ভালো এদেশের রাজনীতির চরিত্রটা বোঝা। অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের দেশের রাজনীতি এখন মূলত পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। সেই রাজনীতি ময়দানে হোক বা পেশাজীবীদের অন্দরমহলে হোক। পাইয়ে দিতে বা নিয়ে নিতে একটা পরিচিতি প্রয়োজন। যেমন কোনও পেশাজীবী সমিতির বড় পদ, তারপর সেই পদে বসে পদলেহন। যদি কিছুটা অশিক্ষিত হওয়া যায়, যদি খুব বেশি করে রুচিহীন হওয়া যায়, যদি প্রতারক হওয়া যায়, তাহলে আরও বেশি প্রাপ্তি।
এখন সর্বত্র এই পাইয়ে দেওয়া বা নিয়ে নেওয়ার গল্প। কে কোথায় কী পেয়ে যাচ্ছে বা নিয়ে নিচ্ছে, সেই গল্প। ক্ষমতা কাঠামো ব্যবহার করে যা পাওয়া যায় হাতিয়ে নেওয়ার গল্প।
পেশাজীবীদের সংগঠনে বসে এরাই আপস করে ওদের সঙ্গে যারা রসরাজ, রামু বা লালমনিরহাটের ঘটনা ঘটায়। আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক, উকিল, চিকিৎসক বা প্রকৌশলীদের রাজনীতিতে এত দিন অবধি এসবের অস্তিত্ব ছিল না তেমন। যা ছিল এবং আছে, তার নাম ছিল আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচিতি। কিন্তু এখন রাজনীতি তো বটেই, সমাজজীবনও রাজনৈতিক পরিচিতিকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে এসব। এমন সুবিধাবাদী চরিত্র কোথাও এতটা উন্মোচিত হয়নি আগে।
সরকারি, প্রশাসনিক স্তরের সুবিধা বা পদ পদবি পাইয়ে দেওয়া বা নিয়ে নেওয়ার দল সুবিধা নিয়েছে, কিন্তু এরা আসলে আদর্শিক জায়গায় কোনও অবদান রাখেনি। এরা নিতে আর দিতে রাজনীতিকেই প্রধান পরিচিতি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এরা কখনও মানুষের, এদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনীতিটা করেনি, এখনও করছে না যদিও মুক্তিযুদ্ধের ব্যানারটাই এরা ওদের হয়ে ব্যবহার করে।
রাজনীতি যারা সরাসরি করে, তাদের এক প্রকার লড়াই আছে, কষ্ট আছে, নিপীড়ন আছে। কিন্তু পোশাজীবীদের ভেতর যারা পাইয়ে দেওয়া আর পেয়ে যাওয়ার লড়াই করে তারা ভয়ংকর। এদের কোনও অঙ্গীকার নেই, আছে সেই ওদের হয়ে দলের ভেতরে কাজ করা। দলকে সর্বব্যাপী, শক্তিমান করার তাড়না আছে। পেশাজীবীদের কাছ থেকে যে প্রত্যাশা সেটা ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জিইয়ে রাখা। কিন্তু এই সর্বভুক পেশাজীবী নেতাদের কারণে সব আজ অনার্জিত।
এদের কারণেই দলের বাইরে, সরকার-প্রশাসনের বাইরে এমন কোনও পরিসরই তৈরি হয়নি, যেখানে সাধারণ মানুষ এবং স্বাধীনতার সপক্ষের কোনও ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে পৌঁছুতে পারে। সবখানে এখনও ওরা।
ওরা যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। যেন আমাদের সবকিছু আটকে গেছে রাজনৈতিক পরিচিতির খোপে পোস্টিংবাজ পেশাজীবী নেতাদের খপ্পরে।
এই যে লালমনিরহাটের উন্মত্ততা, মুরাদনগরের সাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ, এগুলোর সবকিছুতেই আছে পেশাজীবীদের ব্যর্থতা। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের খোসা ছাড়ালেই অনেক রাজনীতির রং দেখা যাবে। সেই রাজনীতি হলো পাইয়ে দেওয়া বা নিয়ে নেওয়া। এটাও এক প্রকার দখল সংস্কৃতি, যা ছাড়া আমাদের পেশাজীবী রাজনীতি চলে না।
লেখক: সাংবাদিক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.