এ কে এম শাহনাওয়াজ:
বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় সমাজ ও রাজনীতিকে একটি সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব স্বপ্নকল্পের মতোই মনে হতে পারে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন মানব সমাজের শুরু থেকেই মানুষ কমবেশি বহন করেছে। তারপরও মানুষ এবং মানুষের গড়া সভ্যতা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সম্ভবত সভ্যতার নির্মাতা মানুষ বলেই। মানুষই দুর্নীতি আর অন্যায়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়, আবার বিপন্ন মানবতাকে রক্ষা করার জন্য মানুষই ঘুরে দাঁড়ায়। হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতা তাই এগিয়ে চলছে আবর্তিত হচ্ছে একটি বৃত্তের মধ্যেই। যার ভিত্তিতে সভ্যতার উত্থান, তারপর বৃত্ত বেয়ে ওপরে ওঠা। সভ্যতার বিকাশ, একসময় বৃত্তের চূড়ায় পৌঁছায় অর্থাৎ বিকাশের চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছায়। আর এগিয়ে চলার পথ নেই। তাই পরবর্তী পর্যায়ে সভ্যতার অবধারিত পতন। পতনের মধ্য দিয়ে ভিত্তিতে ফিরে আসা। কিন্তু নির্দিষ্ট সভ্যতা বা জাতিসত্তার এটি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয়। সঠিক পথনির্দেশনা এবং ঐতিহ্যের প্রেরণায় প্রাণিত হতে পারলে নতুন প্রজন্ম হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে আবার দেশপ্রেমের শক্তিতে যূথবদ্ধ হতে পারে। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিটি তৈরি হবে এখানেই। আবার সভ্যতা বিকাশের যাত্রাপথে নিজেদের সবল অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবে। অর্থাৎ সভ্যতার নবউত্থান হবে।
বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্য, বর্তমানের বন্ধ্যাত্ব এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশা ওপরের দৃশ্যপটের সঙ্গে খুব মিলে যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগব্যাপী প্রায় দুই হাজার বছরের এক স্বর্ণালি অতীত ছিল এদেশের। তারপরের পতন প্রক্রিয়ায় অবধারিতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছি আমরা। চলমান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চারিত্রিক অধঃপতনকে অনেক বেশি ত্বরান্বিত করেছে। ইতিহাসের পর¤পরা ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষ পতন প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একে নবউত্থানের প্রস্তুতিই বলা যেতে পারে। রাষ্ট্রভেদে সমাজভেদে উত্থানের প্রস্তুতি দ্রুত বা মন্থর হতে পারে। তা নির্ভর করে নতুন প্রজন্ম যাদের হাতে থাকে এগিয়ে চলার পতাকা তাদের কতটা প্রস্তুত করা গেছে তার ওপর।
দার্শনিক সক্রেটিস এই কঠিন জায়গাটি সহজ করার জন্যই তরুণ প্রজন্মকে ঐতিহ্য সচেতন করতে চেয়েছিলেন। আর সুকঠিন প্রস্তাবটি রেখেই বলেছিলেন কহড়ি ঞযুংবষভ ‘নিজেকে জানো।’ নিজের অস্তিত্ব আর ঐতিহ্যকে না জেনে নিজেকে জানা সম্ভব হয় না। দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরি না হলে দেশকর্মী হওয়া সম্ভব নয়। এ জন্যই আজকের বাংলাদেশে অসুস্থতা ও স্বার্থপরতার মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলা বিবর্ণ রাজনীতি যখন তারুণ্যকে সঠিক পথনির্দেশনা দিতে পারছে না, বরঞ্চ বিভ্রান্তি ও লোভের বৃত্তে ফেলে দিচ্ছে তখন এদের উদ্ধার ও আলোকিত পথ দেখানোর দায় তো রয়েছেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব অগ্রজের। কিন্তু যে পথকে অনেক আগেই আমরা বন্ধুর করে ফেলেছি করে ফেলেছি অচেনা, সে পথের খোঁজ পাওয়া ও হাঁটা তাই সহজ নয়। নষ্ট রাজনীতি তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করেছে। সন্ত্রাসী বানিয়েছে। দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলেছে। তাই সতীর্থ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বা নিরাপদ সড়ক চাওয়ার আন্দোলনে জমায়েত প্রতিহত করতে নষ্ট রাজনীতির দায়ে আবদ্ধ শিক্ষার্থীরাই কেন লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে! কেনই-বা তারা সতীর্থকে রক্তাক্ত করে দিতে পারে পাশবিক উল্লাসে। কেনই বা কভিড-কালেও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য আপাত শান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলাটে করার জন্য রাজধানীতে গণপরিবহনে আগুন দেওয়া হবে!
এই সমাজেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিকেল কলেজে পড়তে আসা মেধাবী সুবোধ ছাত্রটি কী এক মায়ার ছলনায় রাজনৈতিক ষ-া হয়ে যায়। নিজেদের অপকীর্তি যাতে প্রকাশ না পায় তাই সাংবাদিক পেটাতে দ্বিধা করে না। সাংবাদিকের ক্যামেরা ভেঙে দিয়ে বীরত্ব দেখায়। নিজ শিক্ষকও লাঞ্ছিত হন এসব রাজনৈতিক বখাটেদের হাতে। রাজনীতির লেবাস পরা তরুণরা টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, দখলবাজের অভিধায় অভিহিত হয়। এ কারণেই বর্তমানে জগদ্দল পাথরের মতো জমে থাকা সংকট থেকে বেরিয়ে এসে সমাজ, পরিবেশ আর রাজনীতিকে মার্জিত ও সুশীল করে ফেলার সমাধান খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই সঠিক পথ চেনার জন্য আমাদের প্রয়োজন জরুরি কয়েকেটি প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এবং প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা।
আমাদের নিজেদেরই আবিষ্কার করা এখন জরুরি কর্তব্য। মানব জন্মটাই শেষ কথা নয়। জন্মের দায় বলে দেয় সমাজ, পরিবেশ ও রাষ্ট্রকে দেওয়ার জন্য প্রত্যেকেরই অবধারিত কর্তব্য রয়েছে। এই কর্তব্যকে চিহ্নিত করতে হবে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে। আর তা করতে পারলেই সম্ভব হবে অভীষ্ট স্থির করা। সুন্দরের প্রত্যাশায় পথ চলতে হলে নিজের বর্তমান অবস্থান ও চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কে রাখতে হবে স্পষ্ট ধারণা। এভাবেই লক্ষ্য চিহ্নিত হবে। আমাদের গন্তব্য কোথায় তা সুনির্ধারিত হলেই একটি সম্ভাবনার আলো আমরা দেখতে পাব।
ধর্ম এবং রাজনীতি এই দুই জরুরি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো দায় নেই। ধর্মের নাম ভাঙিয়ে বা অপব্যখ্যা দিয়ে কোনো ধর্মীয় নেতা বা গোষ্ঠী যখন নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধার্মিক মানুষের আবেগ ও সরলতার সুযোগে নিজেদের সুবিধা আদায় করতে মাঠে সক্রিয় হয় তখন মানবতা বিপন্ন হতে পারে। প্রতারক সুবিধাবাদীরা এভাবে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে। প্রাচীন বাংলায় ব্রাহ্মণ সেন রাজারা নিজেদের অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে যাতে সাধারণ বাঙালি প্রতিবাদী না হতে পারে সে জন্য সমাজে কঠোর বর্ণপ্রথা আরোপ করেছিল। প্রতিবাদী বাঙালিকে শূদ্র শ্রেণিভুক্ত করে নিজেদের প্রযোজিত বিধি ধর্মের নামাবরণে তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। আমরা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়লে দেখব কোনো ধর্মই মানবতা বিপন্নকারী কোনো দর্শন ধারণ করে না। ইউরোপে মধ্যযুগের শুরুতে রোমান পোপরা পারলৌকিক ও ইহলৌকিক উভয় ক্ষমতার অধিকারী হতে গিয়ে মানবতা বিপন্ন করেছিলেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতারিত করতে চেষ্টা করেছিলেন মানুষকে। যে কারণে খ্রিস্টধর্মকে লাঞ্ছনার হাত থেকে রক্ষা করতে, ধর্মের পবিত্রতা ও মানবিক আবেদনকে ছড়িয়ে দিতে ধর্মগুরু সৎ সাধুরা ‘প্যাপাসি’ বা পোপতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। মঠতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তারা মানবতাকে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন।
শান্তির বাণী নিয়ে আসা ইসলাম আর জঙ্গিবাদী ইসলামের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? ধর্মের নাম ভাঙিয়ে ধর্মচর্চা বিচ্ছিন্ন সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে এক শ্রেণির ধর্মবণিক নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য জঙ্গিবাদ নামে ইসলামের গায়ে একটি কুৎসিত পোশাক পরাতে চাইছে। এই তো সম্প্রতি আমাদের খ্যাতিমান ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ভারতে পূজাম-পে গিয়েছে বলে এক শ্রেণির বিভেদ সৃষ্টিকারীরা ফেইসবুক গুলজার করেছে। সিলেটের এক বিকৃত চিন্তার ছেলে ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করেছে। সে অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দিয়েছে সাকিব আল হাসানকে। আমার মনে হলো এই বদ্ধবুদ্ধির ছেলেটি নিজ ধর্মকে যেমন গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি তেমনি আমাদের আবহমানকালের উজ্জ¦ল সংস্কৃতি সম্পর্কেও নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এখন পুলিশ যদি তাকে সুপথের দিশা দিতে পারে।
আজ আমাদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য বিনষ্টের পেছনে এ ধারার নানা অপচ্ছায়া সক্রিয় রয়েছে। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির মতো পুরনো প্রতিষ্ঠানও অপব্যবহারকারীদের হাতে এতটাই লাঞ্ছিত হচ্ছে যে ‘রাজনীতি’ই যেন একটি নেতিবাচক শব্দে পরিণত হচ্ছে। অথচ আমরা বিশ্বাস করি সুস্থ রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমাজ প্রগতি ও অর্থনৈতিক মুক্তি কোনোটিই সম্ভব নয়।
তাই যে প্রস্তাব নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম অর্থাৎ নিজেকে আবিষ্কার ও নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করার পথে অগ্রসর হওয়া একে সহজ করার জন্য অবশ্যই সমাজে ক্ষত সৃষ্টিকারী অশুভ মানুষ ও গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি বর্তমান নৈরাজ্যিক পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে শুভ সকালে পৌঁছতে হলে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। সামাজিক আন্দোলনের মধ্যদিয়েই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি ছাড়া এই আন্দোলন সফল হওয়ার নয়। আপাত ধোঁয়াটে মনে হলেও আমরা বিশ্বাস করতে চাই দেশপ্রেমের শক্তি এই পথ পরিক্রমণ সহজ করে দেবে। আবহমানকালের বাংলার ঐতিহ্যচর্চা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে শক্তি ধারণ করতে পারলে দেশের প্রতি ভালোবাসা উৎসারিত হবে। এই চেতনার ফল্গুধারা প্রজন্মকে ভাবতে সাহায্য করবে কেমন একটি রাষ্ট্রভাবনা ধারণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে উদ্দীপ্ত বাঙালি। কেমন সমাজ ও অর্থনীতি গড়তে আমরা চেয়েছিলাম। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা কতটা প্রবল ছিল। আমাদের আজ মূল্যায়ন করতে হবে এসব লক্ষ্য অর্জনে আমরা কতটুকু সফল হয়েছি। ব্যর্থতা থাকলে তার কারণ শনাক্ত করা জরুরি। যা কিছু সাধারণ জনগণের পক্ষে নয় দল ও গোষ্ঠীর সুবিধাকে প্রাধান্য দেয় সাধারণত সেভাবেই প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আদর্শ তৈরি হয়। ন্যায়বিচারের পক্ষে মুক্তধারা প্রতিষ্ঠা পায় না। তেমন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ভাবনা বজায় রেখে সমাজ বদলানো সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সাংস্কৃতিক ভাবনায় রূপান্তর আনা।
যে সমাজে অবক্ষয়ের ধারা চলছে দীর্ঘদিন থেকে, ন্যায়নিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে তার রূপান্তর রাতারাতি সম্ভব নয়। প্রস্তুতির জন্য এক দুই প্রজন্ম অতিক্রান্ত হতেই পারে। অশুদ্ধ রক্তকে বিশুদ্ধ করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর এমন শুদ্ধতায় ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধান শক্তি হতে পারে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। এ কারণেই আমাদের ভাবনা ঐতিহ্যচর্চার মধ্যদিয়ে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা। দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রজন্মকে দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের ঘেরাটোপ থেকে রক্ষা করতে পারবে। আত্মশক্তি প্রবল হবে। তারুণ্যের এই ঐক্যবদ্ধ নিষ্পাপ শক্তির কাছে অশুভ শক্তি মাথা নোয়াতে বাধ্য। রাজনীতির সুবিধাবাদী দুষ্ট নাবিকরা শুভ স্রোতের অনুকূলে পাল ঘোরাতে বাধ্য হবে। অস্তিত্বের প্রয়োজনেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। আজকের নষ্ট সময়কে সেই দিনের কাছে নিয়ে যেতে তাই প্রয়োজন আত্মজিজ্ঞাসা ও ঐক্যবদ্ধ শপথ।
লেখক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়/shahnawaz7b@gmail.com.
সূত্র: দেশরূপান্তর/ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.