চিররঞ্জন সরকার:
সমাজের মূল্যবোধগুলো খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যে যত উগ্র, হিংস্র, ঠোঁটকাটা, কানকাটা, খেয়ালি, সে তত জনপ্রিয়। বাংলায় যাকে বলা চলে ‘যত বড় পাঁঠা তত বড় আসন’। সুবোধ, শান্ত অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জেনারেশন এখন সমাজ থেকে উধাও। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকেও। এখন ঘাড়ত্যাড়া, টেটিয়া, একরোখা, রাগী মানুষরা সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের প্রধান আদর্শ ও লক্ষ্য হচ্ছে, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। অন্য কারও জন্য নয়, নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য লড়ো এবং প্রয়োজনে মরো।
ব্রিটিশের আমলে কথাটি ছিল ডিভাইড অ্যান্ড রুল। আর এখন হয়েছে ভাগ কর, দখল কর। গায়ের জোরে শাসন কর। একটা বেপরোয়া ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সবখানে। পুরো পৃথিবী কাঁসার বাসনের মতো ঝনঝন করে বাজছে। চামার-কামার, সুশীল, মন্ত্রী, জঙ্গি সবাই ষণ্ডা-গুণ্ডার মতো আচরণ করছে।
মিনিমাম টলারেন্স নেই। কেবল হুমকি-ধমকি, অশ্লীল গালাগাল। এরা বীর। এদের থিম হলো, মারো শালা। সপাটে মারো, স-ডাঁটে মারো। ঘ্যাঁক করে কামড়ে দেওয়াই এখন স্মার্টনেসের ঝলমল পতাকা। মানুষও এখন অভদ্রতার তুমুল ফ্যান।
আর দেশে দেশে ‘অবতারের’ মতো দেখা দিয়েছে ডাকসাইটে সব ‘নেতা’। ব্রেক নেই, বেল নেই, নিয়মনীতি-শিষ্টাচারের বালাই নেই। আছে শুধু হুঙ্কার, ক্ষেপিয়ে দেওয়া, চটিয়ে দেওয়ার কৌশল। ভারতে মোদি, ইসরায়েলে নেতানিয়াহু, তুরস্কে এরদোয়ান, পোল্যান্ডে দুদা, ফিলিপাইনে রদরিগো দুতের্তে, রাশিয়ায় পুতিন, ব্রিটেনে বরিস জনসন, ব্রাজিলে জাইর বলসোনারো ও চীনে শি জিনপিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবী জুড়ে এত জন কট্টর ‘জাতীয়তাবাদী’ ‘অবতার’কে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির তখতে বসে থাকতে বোধ হয় আমরা আগে দেখিনি। আর সদ্যবিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন এই বৃত্তটি সম্পূর্ণ করেছিলেন।
এই ‘অবতার’রা যে জাতীয়তাবাদের কথা শোনান তা দেশবাসীকে নয়, দেশকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। দেশ নামক বিমূর্ত ধারণাটিকে দেশবাসীর মাথায় গেঁথে দেওয়ার জন্য এমন দিনের গল্প শোনায় যেখানে ইতিহাস, পুরাণ আর কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তারা ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেন। অতি-জাতীয়তাবাদের একটি প্যাটার্ন বুনে দিয়ে তারা সমস্যাকে ধর্মের প্রিজমে দেখতে চান।
পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের ধ্বংস করার কাজে সহায়তা করছে। কিন্তু পুতিন নিজ দেশে একজন শরণার্থীকেও আশ্রয় দেননি। ক্রিমিয়ার দখল পেতে ইউক্রেনের ওপর আগ্রাসন তিনি চালিয়েছেন, নিজ দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হাসপাতালে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন। তারপরও সমীক্ষা বলছে, রাশিয়ার প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ পুতিনের আগ্রাসনকে সমর্থন করেছেন।
শুধু পুতিনের রাশিয়া বা পোল্যান্ড বা তুরস্ক নয়, ইউরোপ জুড়েই অতি রক্ষণশীল, উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের সমর্থন পাচ্ছে ফ্রান্স, হল্যান্ড কী স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে দশ থেকে ২০ শতাংশ ভোট এই উগ্রবাদীদের দখলে। সিরিয়া ও আফ্রিকার শরণার্থী সমস্যা অবশ্যই ইউরোপের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে মার্কেলের মতো তুলনায় উদারপন্থি নেতাদের ওপরে আর ভরসা রাখতে পারছেন না তারা। সবখানেই উগ্র জাতীয়তাবাদের এত বাড়বাড়ন্ত।
এর সঙ্গে অবশ্য অর্থনৈতিক টানাপড়েন আছে। তুরস্কের কথাই ধরা যাক। একজন তুর্কি দেখছেন বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া কী মাল্টার মতো দেশও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাচ্ছে স্রেফ ধর্ম ও বর্ণ পরিচয়ে। একজন পোলিশ দেখছেন একমাত্র ইউরোপীয় দেশ হিসেবে মন্দার বাজারে সাফল্যের মুখ দেখলেও লভ্যাংশের সিংহভাগটা সেই চলে যাচ্ছে ইউরোপীয় সুপারপাওয়ারদের কাছেই। সার্বিয়ার মানুষরা দেখছেন শুধু রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢুকতে পারছে না।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা হোক বা আইএমএফ, জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সাধারণ মানুষের কাছে এই সংস্থাগুলো যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল, তার অধিকাংশই পূর্ণ হয়নি। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও আর্থিক বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার যে খনিশ্রমিকরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতাবেন বলে পণ করেছিলেন, তাদেরও কিন্তু ধোঁকার টাটি কম দেখানো হয়নি। বিশ্বায়নের দৌলতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজ অনেক কিছু পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই এক কুমিরছানাকে বারবার দেখিয়ে উন্নত দেশগুলো তার ফায়দা তুলেছে হাজার গুণ। স্বভাবতই যে মানুষগুলোর ভাগ্যে কিছুই জোটেনি, তারা নিজেদের প্রাথমিক পরিচয়েই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের শুরুর কথাও সেখানেই লুকিয়ে।
উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বাড়বাড়ন্তের পেছনে সাধারণ মানুষের আশাভঙ্গের এই আখ্যানটির গুরুত্ব কম নয়। তবে উগ্র জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আবার জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জাতি-ক্রোধের মিশেল দিয়েছেন। একজন সাধারণ ধনী ব্যক্তি থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠা ডোনাল্ড ট্রাম্প ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে যে অনেক গবেষণার বিষয় হবেন, তাতে মার্কিন সমাজ-অর্থনীতির সংকট এবং বিশ্বায়িত অর্থনীতি ও রাজনীতির বিচিত্র আখ্যানের সঙ্গে আর একটি বিষয়ও থাকবে সেটা হলো ক্রোধের স্থূল প্রকাশে জনমানসের আকর্ষণ। নাট্যরঙ্গ, বিদ্রুপ-আক্রমণের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভকে দৃষ্টি-আকর্ষক করে তোলার নাছোড় বাসনা।
এবারের নির্বাচনেও যে বিরাটসংখ্যক মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এর মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও বাস্তববোধের অভাব শুধু নয়, স্থূল হিংসা ও উন্মাদনার প্রতি অসীম অনুরাগও ফুটে উঠেছে।
ট্রাম্পের ট্রাম্প-কার্ডটির সন্ধান এই স্থূল-ক্রোধ সংস্কৃতিতেই। প্রচারমাধ্যম দ্বারা তিনি যে বিপুল উপকৃত হয়েছেন, তাও এই সংস্কৃতির সৌজন্যে। প্রশ্ন এই যে, এত দিনের আত্মগর্বী লিবারেল গণতন্ত্রের পরিসরে এমন এক জাতিবিদ্বেষী, বিভেদ-হুঙ্কারী নায়কটির জন্মদাতা এই পুঞ্জীভূত বিপুলাকার ক্রোধ এলো কোত্থেকে?
গত এক দশকের আর্থসামাজিক সংকটের মধ্যেই আছে তার সূত্র। সেই সূত্রে বিশ্বজোড়া মন্দার পাশেই স্থান নেবে সে দেশের ওয়াল স্ট্রিট-তন্ত্রের বিপর্যয়। বৃহৎ পুঁজির সংকোচনের দাম ক্রমে প্রাত্যহিক জীবনকে দিতে হয়েছে। নীল-কলার শ্রমিকের প্রকৃত আয় কমেছে, চাকরির সুযোগ ও ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। সামরিক অভিযানের জন্য রাজস্বের ওপর প্রবল চাপ পড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম ও বাজেট ছোট হয়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত করদাতারা দিনের হিসাব মেটাতে না পেরে খাবি খাচ্ছেন। ট্রাম্পের সমর্থকরা তাই প্রধানত দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। ২৮ শতাংশ নারীর পাশে ৪৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৫০,০০০ ডলারের নিচে রোজগার এমন নাগরিকদের ৫০ শতাংশ ট্রাম্পের পক্ষে ছিলেন।
অর্থনৈতিক সংকট যে কত দ্রুত সামাজিক ও রাজনৈতিক রক্ষণশীলতায় পরিণত হয়, সম্প্রতি ব্রিটেন ও আমেরিকা তা প্রমাণ করেছে। অভিবাসী সমাজের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলেই যেন সব সংকটের সহজ চটজলদি সমাধান মিলতে পারে। ট্রাম্পের অভিবাসী-বিরোধিতার প্রবল উদ্গার তাই দেশজোড়া জনপ্রিয়তা কুড়োতে সফল।
অর্থাৎ আমেরিকার ট্রাম্প-অভ্যুত্থান ব্রিটেনের ব্রেক্সিট আন্দোলনেরই নামান্তর। ইতিমধ্যে একের পর এক সন্ত্রাসের ঘটনায় কখনো ইসলামি জঙ্গি, কখনো ক্রুদ্ধ কৃষ্ণাঙ্গ বন্দুকবাজদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ক্রোধাগ্নিতে ইন্ধন পড়ছে। বহুবিভক্ত রিপাবলিকানরা কিন্তু একটি বিষয়ে সংঘবদ্ধ : বন্দুকের অধিকার। এটা মোটেই অতিরঞ্জিত নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রধান ভূমিকায় আছেন বন্দুক-লবির ধারক-বাহকরা। পেছনের দিকের একটি বন্ধ বন্দুকঘরের দিকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন তারা : সেই দৌড়ে গতি জুগিয়েছেন অধিনায়ক ট্রাম্প।
আর বিশ্ববাসী সেই উন্মত্ত দৌড় হাঁ-করে চেয়ে দেখছেন আর হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন। কারণ? এখন অশিষ্টতা উদযাপনের যুগ। অশ্লীল আত্মবিজ্ঞাপনকে এখন বলে মার্কেটিং, অন্যকে অনর্গল অপমান করার প্রবণতাকে বলে সপ্রতিভতা, হিংসা ও আঘাত করার অভ্যাসকে বলে আগ্রাসন।
কেবল রাজনীতি নয়, ক্রীড়া নয়, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই, সকল নম্রতা নিয়ম-রীতিনীতি ভুলে, আদিম দখল-মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াই এখন নীতি। অন্যদিকে ভালো মানুষও দেখছে, তার হাত থেকে অ-ভালোরা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে চাকরি, সম্মান, প্রেম, যৌনতা, পিৎজা ও লজেন্স।
নিজেকে তার নিয়ত বিপন্ন মনে হতে থাকে, একসময় আত্মসন্দেহ, এমনকি আত্মঘৃণার দিকেও সে ঢলে পড়ে। নীতিনৈতিকতাহীন এমন জয়ীদের অট্টহাসি তার মর্মে এসে আছড়ায় ও বস্তুগত ব্যর্থতার দায় তার ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে বসে। ফলে ‘পাঁঠা’দের প্রতি সেও নমনীয় হয়ে ওঠে। ফলে পাঁঠারা আরও বড় আসনে অধিষ্ঠিত হয়!
লেখক লেখক ও কলামনিস্ট/chiros234@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.