রুমিন ফারহানা:
‘বিশ্বে ১৯৩টি দেশ আছে। সব দেশেই কিছু ‘অকাম-কুকাম’ হচ্ছে। কিন্তু ওইসব দেশ নিয়ে কেউ কথা বলে না। এর কারণ হচ্ছে, ওইসব দেশের মানুষ এগুলো নিয়ে এতে ব্যস্ত থাকে না। আমাদের দেশের কিছু সাংবাদিক এবং এনজিও সারাক্ষণ এসব নিয়ে মাথা ঘামায়। মাথা ঘামায়, কারণ তারা এজন্য বিদেশ থেকে অর্থ পায়। এসব নিয়ে তারা বিদেশিদের কাছে বারবার ধর্ণা দেয়, তাদেরকে ত্যক্ত করে। এ কারণেই বিদেশিরা এসব নিয়ে কথা বলে। আমরা যত কম লাফালাফি করবো, ততই মঙ্গল।’
কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ‘এভ্রিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) এর আওতায় বাংলাদেশকে দেওয়া বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শ্রমিক অধিকারের পাশাপাশি এবারই প্রথম বাক স্বাধীনতা সহ সার্বিক মানবাধিকার নিশ্চিতের শর্ত জুড়ে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের অবাধ বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছিল ওবামা প্রশাসন। বলা হয়েছিল, কাজের পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে। এই স্থগিতাদেশ দেওয়ার সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আদেশে বলা হয় ‘আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করাই শ্রেয়। কারণ, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি কিংবা নিচ্ছে না।’
অভিযোগ গুরুতর সন্দেহ নেই। এর আগে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে একের পর এক দুর্ঘটনা এবং বিপর্যয়ের কারণে কারখানার কর্ম পরিবেশের উন্নয়ন ও শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বারবার তাগিদ দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন।
জানিয়ে রাখি, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এই সুবিধা এখন পেয়ে গেলেও জিএসপি সুবিধা এখনও ফিরে পায়নি বাংলাদেশ। নিশ্চিতভাবেই কাজের পরিবেশ এখনও উন্নত হয়নি। যেহেতু মার্কিন জিএসপিতে পোশাক রফতানি ছিল না, তাই মার্কিন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি খুব বেশি না হলেও ভীষণ সংকটে পড়েছিল ভাবমূর্তি।
বাংলাদেশের এই ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তির ফল দেখা গেছে গত ২৯ অক্টোবর। ওইদিন প্রথমবারের মতো জিএসপি চালু রাখার ক্ষেত্রে বাক স্বাধীনতা সহ সার্বিক মানবাধিকার নিশ্চিতের শর্ত জুড়ে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবারই প্রথম মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউপিআর বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পরিকল্পনা চেয়েছে। এর আগে ইইউ কখনও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাণিজ্য সুবিধার সঙ্গে মানবাধিকারের ইস্যুকে যুক্ত করেনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) বাস্তবায়নের জন্য তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে চিঠি দিয়েছিল ইউএন হিউম্যান রাইটস কমিশন। কমিশনের ইউপিআরে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার, নাগরিকদের সভা-সমাবেশ করার অধিকারসহ রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৩২ ধারা বাতিল করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০১৮ সালের পর দুই বছর পার হলেও মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিস্থিতির উন্নতি দূরেই থাকুক অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ২০২৩ সালে জিএসপি সুবিধা বলবৎ থাকবে কিনা সেটাই এখন অনিশ্চিত। অনিশ্চিত যে কতটা নিশ্চিত সেটা এই কলামের শুরুতে বলা মন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৯ সালে তাদের বাৎসরিক রিপোর্টে বাংলাদেশ বিষয়ের শুরুতেই যে বিষয়গুলো নিয়ে এসেছে তার মধ্যে আছে—বিচারবহির্ভূত হত্যা, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ব্যবহার করে সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট, মানবাধিকার কর্মী গ্রেফতার-নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা, বাক স্বাধীনতা হরণ, সভা-সমাবেশের ওপরে বাধা, গুম ইত্যাদি। একই ধরনের কথা উঠে এসেছে আরেকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর ২০১৯ সালের রিপোর্টেও। তবে এই দুই সংস্থার রিপোর্টে যে জায়গাটিতে কিছুটা তফাৎ দেখা গেছে তা হলো, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ২০১৮ এর বিতর্কিত নির্বাচন এবং এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে সরকারের নীরবতাকেও প্রশ্ন করেছে।
মুক্ত সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা ফরাসি সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স স্বাধীন সাংবাদিকতা নিয়ে প্রতি বছর র্যাংকিং প্রকাশ করে। ২০২০ সালের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ আগের বছরের চাইতে এক ধাপ পিছিয়ে ১৫১তম অবস্থানে ছিল। আমাদের পরিস্থিতি বুঝতে আশপাশের কিছু দেশের অবস্থান জেনে নেওয়া যাক; ভারত-১৪২, শ্রীলংকা-১২৭, নেপাল-১২২, মালদ্বীপ-৭৯, ভুটান-৬৭। আমাদের দেশে নানা কারণে খুব সমালোচিত দেশ পাকিস্তান এই র্যাংকিংয়ে আছে ১৪৬তম। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ১২২তম, এমনকি মিয়ানমারের অবস্থাও আমাদের চাইতে ভালো, ১৩৯। ফেসবুকে বাংলাদেশকে ট্রলের ক্ষেত্রে হালের ট্রেন্ড উগান্ডার সঙ্গে তুলনা; এই উগান্ডাও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের চাইতে অনেক ভালো অবস্থায় আছে, তাদের র্যাংকিং ১২৫।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বাণিজ্য সুবিধার সঙ্গে প্রথমবারের মতো মানবাধিকার ইস্যুকে যুক্ত করার জন্য কিছু সাংবাদিক ও এনজিও কর্মীকে দায়ী করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়।
এক. তার বক্তব্যেই তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা পরিস্থিতি নাজুক, কেননা পরিস্থিতি যদি ভালো হতো তাহলে এ ধরনের কোনও শর্তে মন্ত্রীর বিরক্ত হবার কথা না।
দুই. পরিস্থিতি কী করে ভালো করা যায়, সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে কাকে পরিস্থিতি প্রকাশ করার জন্য দায়ী করা যায়, সেদিকেই সরকারের পুরো মনোযোগ।
তিন. মন্ত্রীর ভাষায় সব দেশেই কিছু ‘অকাম-কুকাম’ হলেও ধরা পড়ে কেবল বাংলাদেশে কারণ বিদেশের টাকা খেয়ে সাংবাদিক এবং এনজিও কর্মীরা বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দেয়।
এই সমস্যার সমাধান আছে দু'টো। সেটা জানার আগে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর নিজ দেশে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব আছে এটা বলা দূরেই থাকুক তুর্কমেনিস্তানের মিডিয়ায় ‘করোনাভাইরাস’ শব্দটিই ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ছিল। এরপর সেই শব্দ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আর বাধা না দেওয়া হলেও তুর্কমেনিস্তানে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব আছে এই ধরনের কোনও কথা কোনও মিডিয়া লিখতে পারে না আজও। হ্যাঁ, অফিসিয়ালি তুর্কমেনিস্তানে একজন করোনা রোগীও নেই, যদিও তার সঙ্গে সীমান্ত থাকা প্রতিবেশী দেশ ইরান, আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান করোনার আক্রমণে ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে।
যেহেতু এই দেশের লোকজন বিদেশের টাকা খেয়ে দেশের ভেতরে ঘটা ‘অকাম-কুকাম’ বিদেশিদের কাছে ফাঁস করে দেয়, তাই সরকার হাঁটতে পারে তুর্কমেনিস্তানের পথে। বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সব শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে মূলধারার কিংবা সামাজিকমাধ্যমে।
আরেকটা পথ হতে পারে নাগরিকরাই সরকারকে সাহায্য করবে। সরকার এত ঝামেলা করে ওসব পথে না যাক। এখানেও নাগরিকদেরকে পথ দেখাতে পারে তুর্কমেনিস্তান। সেখানে করোনা শব্দ ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে একটা পর্যায়ে, কিন্তু তারপরও সেই শব্দ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবাই এটা নিশ্চিত করেছে তুর্কমেনিস্তানের কোথাও করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব নেই। একই পথ অনুসরণ করে আমরাও বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সব শব্দের ব্যবহার করবো, কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এটাও নিশ্চিত করবো এগুলো জনিত কোনও সংকট এই দেশে নেই।
আসলেই এসব নিয়ে ‘লাফালাফি’ করে নিজেরও ক্ষতি, দেশেরও ক্ষতি। একদিকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এর মামলায় ‘দৌড়ের ওপরে’ থাকতে হবে নিজেকে, আবার ওদিকে দেশ হারাবে জিএসপি সুবিধা, নষ্ট হবে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি। তাই সবার মনে রাখা উচিত–‘যত কম লাফালাফি, তত বেশি মঙ্গল’।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.