ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ:
গোমস্তাপুরের মামুন মুনশীর লেখাজোখার অভ্যাস অনেক দিনের। অদ্য সকালে হঠাৎ ‘সাদা-কালো’ শিরোনামে লেখা একটি রচনার চিন্তা মুনশীর মাথায় উদয় হইল। সমকালীন প্রেক্ষাপটে ইহার তাৎপর্য ও পটভূমি অবশ্য আছে। কিন্তু লেখাটি গদ্যে হইবে না পদ্যে হইবে, প্রবন্ধ না নিবন্ধ, গল্প না নাটক হইবে তাহা লইয়া মাথায় নানান ধ্যান-ধারণারা তদবির-তল্লাশি শুরু করিয়া দিয়াছে। রচনাকারীর নাম কীভাবে লেখা হইবে ইহা লইয়াও নানান চিন্তা শুরু হইয়াছে। স্বনামে কিছু করিবার সৎসাহস ও সুযোগরা নানান কারণে ইদানীং গা-ঢাকা দিয়াছে। সাতষট্টি পার করিয়াও এখনো তাহাকে স্বনাম বা ছদ্মনামের আশ্রয়-প্রশ্রয় লইবার চিন্তা মাথায় লইতে হইতেছে। ছদ্মনামে দোষের কিছু নাই। পৃথিবীতে বহু মহাজন ব্যক্তি ইহা করিয়াছেন, কিন্তু তাহাদের সেই ছদ্মনামেরও মাহাত্ম্য ও উদ্দেশ্য বিধেয় ব্যাকরণের ব্যাখ্যা বক্তব্য বিবরণী বিকৃতির বেড়াজাল ডিঙ্গাইয়া সকলের কর্ণকুহরে পৌঁছাইয়াছে। সাকি নামের লেখক, নীলকণ্ঠ, যাযাবর অবধুত, লুব্ধক, গাছপাথর ইহাদের পিছনে কাহারা তাহা সকলেরই জানা। ভলতেয়ার যে কারণে ছদ্মনামের আশ্রয়ে গিয়াছিলেন যাযাবর হয়তো ঠিক তাহা ভাবিয়া করেন নাই। কেহ স্বনামে প্রকাশিত হইতে লজ্জা, কেহবা শরম, কেহবা ভয়, কেহবা সংকোচ, কেহবা ছোট্ট নামের মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজিয়াছেন, কেহবা হাজার কলমের প্রতীকী প্রকাশের প্রয়াস পাইয়াছেন অর্থবহ নাম ধারণের মধ্যে।
মুনশীর ধারণা সাদা-কালোর বিষয়টি বর্তমান সময় ও সমাজে এমন এক পর্যায়ে আসিয়াছে, যাহা উচ্চকণ্ঠ নিচকণ্ঠের ব্যাপার নয় ইহা মূল্যবোধের জন্য একটা দড়ি টানাটানির ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বিভিন্ন রঙের বাহারে বানানো টাকাকে কালো টাকা সাব্যস্ত করিবার বিধিবিধান লইয়া টকশোতে ঝাল-মিষ্টির মহরত চলিতেছে। আদি ও অকৃত্রিম রং সাদা-কালোকে লইয়া মাতামাতি ভালোই চলিতেছে। অথচ সাদার বিপরীতে কালোকেই তো মানায় ভালো যেমন দিন ও রাত, যেমন ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, আনন্দ ও সর্বনাশ। একের উপস্থিতি অন্যের অনুপস্থিতিকে অনিবার্য করিয়া তোলে। হয় তুমি না হয় আমি এই ধরনের একটি বাধাবাধির ব্যাপার আর কি! কিন্তু আমাদের যে উভয়ের দরকার। ‘খোলা আকাশ কি এত ভালো লাগত যদি কিছু কিছু মেঘ নাহি ঢাকত’ ইহা তো সন্ধ্যা মুখার্জীর সুরেলা কণ্ঠের কথা। চাঁদে কলঙ্ক থাকিবে ইহা সাংবিধানিক সত্যের মতো ধরিয়া লওয়া যায় নিন্দার কাঁটা না বিঁধিলে নাকি প্রেমের সাধ পূর্ণ হয় না। সত্যম শিবম সুন্দরমের বাগ-বাগিচায় দু-একটা আগাছা কিংবা নামহীন গোত্রহীন ফুলের পদচারণা মানিয়া লওয়া যায় কি না, তাহা ভাবিবার বিষয়। তবে এই ভাবাভাবির অবকাশে অগোচরে অনেক অকল্যাণ হুড়মুড় করিয়া ঢুকিয়া যে শ্বেতশুভ্র রজনীগন্ধার গায়ে অসংখ্য অসময়ের রেণু স্পর্শ করিতেছে সকাল-বিকাল, তাহার খোঁজখবর বনমালীর নাই। রাখিবার ফুরসতও মিলিতেছে না। সংকোচের বিহ্বলতায় নিজের অপমান আপাদমস্তক নিজেকে নতজানু পর্যায়ে লইয়া যাইতেছে অন্যায়-অনিয়ম আর অবাধ্যতার বসিবার কথা বলিয়া বনমালীর ঘরে যে শুইবার এন্তেজাম করিতেছে এই দিকে বনমালীর মন নাই।
দূরপ্রাচ্যে, সাত সাগর আর তেরো নদীর পাড়ে, ফুলে ফুলে শোভিত এক স্বপ্নরাজ্যে এ দেশের এক দুধকুমার একবার হঠাৎ করিয়া বিস্তর নগদ এনাম লাভ করিয়া বসিলেন। সেই দেশের এমনই নিয়ম যে যেখানে তিনি ইহা লইয়া যাইবেন সেখানেই প্রশ্ন পাইবেন ‘ইহা ভাই আপনি কোথায় পাইলেন?’। এই প্রশ্নে দুধকুমারের লা জবাব অবস্থা দেখিয়া অনেকেই মজা পাইলেন। এর কোনো জবাব তাহার মগজে নাই। অগত্যা তিনি একটি সিন্দুক কিনিলেন এই সিন্দুক তাহার ঘরে উঠাইবার সুযোগও সীমিত। কেননা সে দেশে বাসগৃহে কেহ বড় সিন্দুক ব্যবহার করে না হাজার বছর আগে ইহার চল উঠিয়া গিয়াছে। কেননা ছেঁচড়া চোর, হাত সাফাই এই জাতীয় বদ খাসলতদিগকে নির্বাসনে পাঠানো হইয়াছে। সবই আমানতদারের জিম্মায় রাখিবার বিধান চালু রহিয়াছে। অগত্যা দুধকুমার বিদেশি বাড়ির জানালা কাটিয়া তাহার ঘরে সিন্দুক প্রবেশ করাইলেন এবং যথারীতি তথায় যাবতীয় নগদের নিবাস নির্ধারণ করিলেন। দুধকুমারের ভাগ্য ভালো সেই দেশে দস্যুতায় দুর্দান্ত সম্রাটের পুত্ররা নাই। নইলে ইহা তাহাদের জিম্মায় চলিয়া যাইতে বিলম্ব হইত না। সেই দেশে এমনই নিয়ম যে, একটি আস্ত গাড়ি মাগনা দিলেও কেউ লইতে চায় না, কেননা সেই গাড়ির লাইসেন্স, রুট পারমিট, ইন্স্যুরন্সের দাবি মিটাইতে এবং ইহার মালিকানা লাভের হলফনামা রচনায় চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধারের অবকাশ ঘটিয়া যাইবে। সেই দেশে পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে। সুশাসনের মন্ত্র পড়াইয়া পদ্ধতি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে নাই।
বঙ্কিমবাবু আগের শতাব্দীর লোক ছিলেন। ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। কপালকু-লার আঁকিয়ে ছিলেন। ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ এই প্রশ্ন নিজের কাছে সে সময় সতত রাখিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। কখনো ভাবেন নাই তাহার ভাবীকালের ভাতিজারা ‘তুমি অধম তাই আমিও অধমের মতো আচরণে অধিকারপ্রাপ্ত হইয়াছি’ বলিয়া বিবৃতি দিতেও বিব্রতবোধ করে না। বরং এই রূপ বিবৃতি দিয়া ইহা যেন ‘হাইব্রিড নেতা হিসাবে বাহবা লভিবে তুমি এই সোনার ভুবনে’। বঙ্কিমবাবু হয়তো ভাবেন নাই তাহার প্রোপৌত্ররা ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করিয়াছে গমনের’ প্যারোডি সাজাইয়া ‘যাহারা গিয়াছে গোল্লায়’ আমরা তাহাদের টেক্কা দিয়া ‘দেখাইমু ওরে আঁরাও কম না’। ভাবখানা এই খোকা বোতল ভাঙিয়াছে সুতরাং বোতল ভাঙার গানকে জাতীয়করণ করো খোকা অধিকতর উদ্যমে বোতল ভাঙিতে উদ্বুদ্ধ হইবে।
প্রায় শতবর্ষ পূর্বে রবিবাবু নামে মশহুর এক কবি ভাবিয়াছিলেন অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তাহারা উভয়ে সমান যাতনা সহ্য করিবে। তাহার শতবর্ষ পরে বাবু মহাশয় বাঁচিয়া থাকিলে ঠিকই দেখিতে পাইতেন এখন দোষীকে দিগম্বর করা নহে বরং আঁচলের তলায় রাখিয়া খাঁটি গরুর দুধ ও দেশি কলা খাওয়ানো হইতেছে। চৌর্যবৃত্তিতে পটুরা মাসতুতো বা খালাতো ভাই কিংবা ফাস্ট কাজিনের মতো আত্মীয়তা পাতাইয়া ‘মুই-এর বাড়ি বরিশাল তুয়ার বাড়ি ঘোড়াশাল আমাদের মধ্যে কত মিল’ জাতীয় হেঁয়ালি সংগীত লাফাইয়া দাপাইয়া ঘাটাইয়া মাঠাইয়া চলিতেছে। শুধু ভালোবাসাবিহীন ‘সত্য’ জানালা দিয়া নহে, ‘ভদ্রতা’ ও বিনা টিকিটে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই নদী সাগর পাড়ি দিয়া চলিয়া যাইতেছে অমুক তমুকের দেশে। মাথায় বিস্তর টাক লইয়া চুল সংরক্ষণের ফতোয়া দিয়া যাইতেছেন বাঁশের চাহিয়াও প্রলম্বিত প্রতিভাবানরা। ‘উপ’দের উপদেশে আসলদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বর্ণচোরাদের বন্যায় ত্যাগী ও নিবেদিতরা হালে পানি পাইতেছে না। পানি ও তৈল, দুধ ও ঘি এক দেহে লীন হইয়া একে অপরকে টেক্কা মারিয়া বহাল তবিয়তে থাকিতেছে। থাকিবার উপায়ের উপলক্ষের অভাব নাই, কাজীর খাতাতেও হিসাব অফিসের খাতায় হিসাব রাখিবার বালাই নাই একের মাসোহারা অন্যরা লইয়া যাইতেছে এবং দপ্তরবিহীনদের মিছিল লম্বা হইতেছে। মুহূর্তের মধ্যে অজানা বস্তায় কাঁঠাল গজাইতেছে। বায়োস্কোপের মতো একটির পর একটি ঘটনা ও রটনা আসিয়া চাল-ডাল হইতেছে, গাছ-মাছ হইতেছে, নদী-খাল হইতেছে, ভবন-সদন হইতেছে।
চৌরাস্তায় গোলাপ মিয়া দাঁড়াইয়া দাঁত মাজিতেছিল, হঠাৎ সাদা সরদার আসিয়া বলিল ‘আমাদের বৈঠকখানায় আসিও পিঁড়া দিব বসিতে’, ও পাড়ার মানু মুনশীর মেয়ে নীল নীলাঞ্জনা আসিয়া বলিল, ‘দাদা আমাদের দহলিজে আসিয়া চিড়া-মুড়ি খাইবেন।’ নিরপেক্ষ বেচারা গোলাপ মিয়া। কাহারো ডাকে তাহার সাড়া দিবার ইচ্ছা নাই কিন্তু ইচ্ছা তাহাকে করিতে হইবে নইলে তাহাকে উভয় পক্ষের বাদী-বিবাদীর মালা পরাইয়া সন্ন্যাসী সাজানো হইবে, বানানো হইবে ‘অজ্ঞাত সংখ্যক’দের একজন। গোলাপ মিয়াদের সুদিন সুখ্যাতি এখন সাদা-কালোর সুতায় প্যাঁচাইয়া, আকাশের যত তারা তত ধারায় লটকাইয়া কাশিম বাজার কুঠি হইতে কাশিমপুরে পাঠাইবার প্রজ্ঞাপন হইতেছে হরহামেশা। কালো-সাদাকে পেটে পুরিয়া, গোলাপকে আত্মসাৎ করিয়া বেমালুম সগৌরবে সকলের সামনে দিয়া চলাচল করিতেছে। গুণকীর্তনে বাধা-সাধা হইতেছে বলিয়া রাধারা আর কাহাকে নাচিতেও দিতেছে না। কেহ অন্ন চাহিলে কলা চুরির কেচ্ছা শুনাইয়া, সংগীত-সন্ধ্যা সকালের আমন্ত্রণে চালানো হইতেছে। ইহা যেন বিকেলে ভোরের ফুল সাদা-কালোর মালতী মাধুরীর পথে যাত্রা। শোক সামলাইয়া সত্য যথা তথায় সমাহিত হইতেছে।
লেখক সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
mazid.muhammad@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.