ড. নাদির জুনাইদ:
খুব বেশি দিন আগের কথা নয় যখন মুদ্রিত সংবাদপত্র ছিল শিক্ষিত মানুষের প্রতিদিনের জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান। সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হকারের দিয়ে যাওয়া সংবাদপত্র হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলানো ছিল মধ্যবিত্তের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। কিন্তু হঠাৎই প্রযুক্তির বিপুল প্রসারে টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচার সময় এবং সংখ্যা বৃদ্ধি, ইন্টারনেটের আবির্ভাব আর দ্রুতই তা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্য সহজলভ্য হয়ে যাওয়া প্রভৃতি ঘটনায় মানুষের প্রতিদিনের অভ্যাসেও এসে গেল বড় পরিবর্তন। চিঠির স্থান দখল করল ই-মেইল আর মেসেঞ্জারে পাঠানো বার্তা। সামনাসামনি দেখা করার পরিবর্তে কথা বলা শুরু হলো ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে। টাকা তোলার জন্যও চেক লেখার পরিবর্তে ব্যবহৃত হতে থাকল এটিএম মেশিন। ছাপা বই কেনা বা সংগ্রহ করার পরিবর্তে খোঁজা শুরু হলো ই-বুক বা বইয়ের পিডিএফ ফাইল। সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণও চলে এসেছে। মোবাইল ফোনেই মানুষ এখন সংবাদপত্র পড়তে পারে যে কোনো সময়ই। বর্তমান সময়ে তথ্য সংগ্রহ এবং যোগাযোগ করার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ মানুষ তাই করছে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। নিউ মিডিয়া বিশেষজ্ঞ লেভ ম্যানোভিচ ঠিকই বলেছেন যে, বর্তমান সমাজ একটি স্ক্রিন নির্ভর সমাজ।
অনলাইন প্রযুক্তির কারণে মুদ্রিত সংবাদপত্র আদৌ টিকে থাকতে পারবে কি না গত এক দশক ধরেই তা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। যারা পুরনো অভ্যাসের অনুরক্ত তারা জোর গলায় বলতেন মুদ্রিত সংবাদপত্র না পড়ে অনেক মানুষই তৃপ্তি পাবেন না। তারা সংবাদপত্র কিনবেন সব সময়ই। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো চলে আসা করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রতি অনেক মানুষের নিবিড় নির্ভরশীলতাও পরিবর্তিত হয়েছে। লকডাউনের কারণে অনেক এলাকায় হকাররা প্রবেশ করতে পারেনি। বিভিন্ন জেলায় সংবাদপত্র বিতরণ করার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়েছে। আর সংবাদপত্র হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে প্রতিটি পৃষ্ঠা মন দিয়ে পড়া যাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস, তাদের অনেকেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় বাড়িতে সংবাদপত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ছাপা সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় না এমন গবেষণা তথ্য প্রচারিত হওয়ার পরও অনেক মানুষই নিরাপদ থাকার চিন্তায় সংবাদপত্র কিনছেন না।
ফলে বিক্রি কমেছে মুদ্রিত সংবাদপত্রের। কিছু সংবাদপত্র তাদের মুদ্রিত সংস্করণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানসমূহ টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করার জন্য সরকারি সাহায্যও মহামারীর সময় পাওয়া যায়নি। অনেক সাংবাদিক এই সময় সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। যে কোনো বিপদ বা দুর্যোগের সময়ই সঠিক তথ্যপ্রাপ্তির প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। মানুষ বাড়িতে বসে প্রতিদিন যে দরকারি তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে পাচ্ছে সেই তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সাংবাদিকদের কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে মহামারীর এই সময়ে তা হয়তো খুব কমই আলোচনা করা হয়।
আরেকটি লক্ষণীয় দিক হলো আমাদের দেশে সংবাদপত্র পাঠের প্রতি পাঠকের আগ্রহ আগের চেয়ে কম। একই কথা বলতে হয় বই পড়া সম্পর্কেও। একুশে বইমেলায় প্রতি বছর যে ভিড় চোখে পড়ে তা কি বই কেনার জন্য নাকি বিকেল সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করার জন্য? দেশে চিন্তাশীল বইয়ের দোকান এবং পাঠাগারের সংখ্যা তো বাড়ছে না। বাড়ছে মোবাইল ফোন আর কাপড়ের দোকান এবং বিভিন্ন ধরনের রেস্তোরাঁর সংখ্যা। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বিনোদনমূলক যে নাটকগুলো নিয়মিত প্রচারিত হয় সেখানে এই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তো বই এবং সংবাদপত্র পড়তে দেখা যায় না। বরং এই ধরনের সব নাটকেই দেখা যায় চরিত্রগুলোর দিন কাটছে মোবাইল ফোন কেনা আর ছবি তোলা, বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দেওয়া, আর হৈ চৈ করে জন্মদিন কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান উদযাপনের মধ্য দিয়েই। এখন ইউটিউব, ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, আর নেটফ্লিক্স-এ বিনোদনধর্মী বিভিন্ন উপাদান উপভোগের সুযোগ সহজেই মিলছে কমবয়সীদের। যে পরিবেশে খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে হালকা বিনোদন সেখানে এই প্রজন্মের মানুষরা সংবাদপত্র পড়ার গুরুত্বই যেন অনুধাবন করছে না। মন আলোকিত করার জন্য যে সংবাদপত্র এবং বই পড়া অত্যন্ত জরুরি সেই বক্তব্যও তো পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কমবয়সীদের দেওয়া হচ্ছে না। বরং, ভোগবাদী এই সময়ে প্রতিনিয়ত প্রচার হচ্ছে বহু জৌলুশময় বিজ্ঞাপন যা বিভিন্ন চটকদার পণ্য কেনার প্রলোভন তৈরি করছে নাগরিকদের জন্য।
তাই যখন কমবয়সীদের জিজ্ঞাসা করি তারা নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ে কি না, হতাশ হয়ে দেখি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীই সংবাদপত্র পড়ে না। মুদ্রিত সংবাদপত্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ। যারা সংবাদপত্র পড়ে তারা কখনো অনলাইন সংস্করণে দায়সারাভাবে চোখ বুলিয়ে যায়। অনেক দিন আগে পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত একটি গল্পে পড়েছিলাম কিছু কথা। কথাগুলো আমার মনমতো বলেই লিখে রেখেছিলাম ডায়েরিতে‘পরদিন ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়েছিল সমীরের। চোখে-মুখে জল দেওয়ার আগেই ওর খবরের কাগজে চোখ বুলানো অভ্যাস। এ বাড়িতে বরাবরই ও ফার্স্ট রিডার। হাতে গরম রুটির মতোই একেবারে মেশিন-গরম কাগজের ভাঁজ খোলার একটা আনন্দ আছে। বাবা মজা করে বলেন, আমার বেড-টি আর সুমুর হচ্ছে বেড-পেপার।’ মেশিন-গরম সংবাদপত্রের ভাঁজ খুলে এক একটি পাতায় চোখ বুলানোর যে তৃপ্তি তা কি ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে সংবাদপত্র পড়ে পাওয়া সম্ভব? ছাপা সংবাদপত্রের মতো নান্দনিক প্রচ্ছদ আর ঝকঝকে কাগজে ছাপা একটি বই হাতে নেওয়ার যে তৃপ্তিকর অনুভূতি, নতুন এবং পুরনো দুই ধরনের বই থেকে ভেসে আসা ভিন্ন সুবাস মনে যে আনন্দ এনে দেয় সেই আনন্দ তো কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বই পড়ে কখনোই পাওয়া সম্ভব না। দুঃখজনক যে বর্তমান সময়ে অনলাইন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত কমবয়সীরা এই আনন্দ সম্পর্কে অবহিত না।
ছাপা বই এবং সংবাদপত্র যদি না থাকে তবে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে গভীর এক সৌন্দর্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষের নান্দনিক বোধ। আর দীর্ঘ সময় কম্পিউটার মনিটর বা মোবাইল স্ক্রিনের ইলেকট্রনিক সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখের এবং শরীরের জন্যও অবশ্যই ভালো নয়। মুদ্রিত সংবাদপত্র তাই বিলুপ্ত হবে না, বরং অনলাইন সংস্কৃতির অবাধ প্রসারের সময়ও সংবাদপত্রের ভাঁজ খুলে তা পড়ার প্রতি বহু মানুষের আগ্রহ থাকবে তাই প্রত্যাশিত। মুদ্রিত সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস কমতে থাকার এই সময়েও বাংলাদেশে কিছু সংবাদপত্রের মুদ্রিত সংস্করণ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
‘দায়িত্বশীলদের দৈনিক’এই নীতিসূচক বক্তব্য ধারণ করে দুই বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল দৈনিক ‘দেশ রূপান্তর।’ সংবাদপত্রটির বিভিন্ন দিকে চোখে পড়ে গভীরতা এবং সুরুচি প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা যা এই সময়ে খুব বেশি দৃশ্যমান নয়। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই ‘দেশ রূপান্তর’ পড়ার প্রতি মননশীল পাঠকের আগ্রহ তৈরি হয়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এই সংবাদপত্রের একটি অন্যতম শক্তিশালী দিক। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার কারণে সংবাদপত্রটি প্রশংসা পেয়েছে। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে এমন বিষয় নিয়ে প্রতিবেদনও নিয়মিতভাবেই প্রকাশিত হচ্ছে কাগজটিতে। ফলে, বাড়ছে ‘দেশ রূপান্তর’-এর পাঠক সংখ্যা।
যৌক্তিক বক্তব্য এবং সত্য কথা প্রকাশের সাহস না থাকলে সাংবাদিকতা কখনোই পরিপূর্ণতা পায় না। সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেই কারণে কখনো কোনো কোনো সংবাদপত্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী অসন্তুষ্ট হতে পারে এমন সংবাদ প্রকাশে আগ্রহী হয় না। সংবাদপত্রের এমন মনোভাব হতাশ করে সচেতন পাঠকদের। সংবাদপত্রের গুরুত্বও তখন আর থাকে না কারণ প্রকৃত বাস্তবতার যথাযথ উপস্থাপন এবং নির্মোহ বিশ্লেষণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে চিন্তাশীল পাঠকরা তাই আশা করেন।
‘দেশ রূপান্তর’-এ প্রকাশিত মতামত-নিবন্ধগুলোয় যেমন বিষয়ের নতুনত্ব আছে, তেমনি সেই নিবন্ধগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন ধারালো বক্তব্য। বোঝা যায়, তীক্ষè এবং ঝাঁঝালো বক্তব্য প্রকাশে এই সংবাদপত্রটির সংকোচ বা দ্বিধা নেই। সংবাদপত্রটিতে তাই সচেতন পাঠক লক্ষ করেন প্রশংসা করার মতো এক স্বতন্ত্রতা। সংবাদপত্রটির চেহারাও পরিপাটি। জাঁকজমকহীনতার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে তাই দেখা যায় কাগজটির বিভিন্ন পাতায়। তবে, এই লেখায় সংবাদপত্রের যে ভাঁজের কথা এসেছে ‘দেশ রূপান্তর’-এর সেই ভাঁজ বা ফোল্ডটি প্রায়ই ঠিক থাকে না। তা হয় অসমান, বেঁকে যাওয়া। তা হাত দিয়ে চাপ দিয়ে সমান করে নিতে হয়। যারা মুদ্রিত সংবাদপত্র নিয়মিত কেনেন, সংবাদপত্রের রূপ নিখুঁত না হলে তাদের মন খুঁতখুঁত করে। অনেকেই সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংখ্যা সংগ্রহে রেখে দেন। তাই ‘দেশ রূপান্তর’-এর ফোল্ডে সমস্যাটি যেন না থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার।
সংবাদপত্র পড়ার প্রতি যে অনাগ্রহ বহু মানুষের মধ্যে বর্তমান সময়ে তৈরি হয়েছে, তা দূর করা জরুরি সমাজে সচেতন এবং বুদ্ধিউজ্জ্বল নাগরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনেই। একটি সংবাদপত্র যখন দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং চিন্তাঋদ্ধ বিশ্লেষণ প্রকাশের মাধ্যমে উঁচু মান অর্জন করবে তখনই সেই ভিন্নতার কারণে সংবাদপত্রের প্রতি পাঠকের আগ্রহ এবং আস্থা তৈরি হবে। ‘দেশ রূপান্তর’ এমন উৎকর্ষ অর্জন করুক সেই আশাই করি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অভিনন্দন এবং শুভ কামনা ‘দেশ রূপান্তর’-এর জন্য।
লেখক অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
naadir.junaid@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.