রুমিন ফারহানা:
মানুষ থমকে গেছে। চারপাশে কেবল আক্রান্ত আর মৃতের পরিসংখ্যান। বাড়ছে জীবন আর জীবিকার দ্বন্দ্ব, বাড়ছে অনিশ্চয়তা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এর মাঝেই হঠাৎ একদিন শুনি সুস্থতার সংখ্যা এক লাফে ১৭৭ থেকে বেড়ে ১০৩৬। নিজেকে প্রশ্ন করি, ভুল দেখছি না তো? কী করে সম্ভব? খবর নিয়ে জানতে পারলাম সুস্থতার সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে। নতুন গাইডলাইন তৈরি করেছে আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী সুস্থতার সংজ্ঞা আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা নির্ধারিত সুস্থতার সংজ্ঞা এক নয়। তাতে কী? সংখ্যা বাড়ানো দিয়ে কথা, সেটা বাড়ানো গেছে ভালোভাবেই। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত বা মৃতের সংজ্ঞায় কোনও পরিবর্তন আসেনি। যদি নতুন গাইডলাইন আসতো যে মৃতের তালিকায় নাম উঠাতে হলে অন্তত ৩ দিন শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ থাকতে হবে, তাহলে কী করা যেত?
এরমধ্যেই ১৬ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপন বলছে ঈদ উপলক্ষে সীমিত আকারে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে, দোকানপাট খোলা রাখা যাবে। বিকাল ৫টার মধ্যে সব মার্কেট বা দোকান বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি শপিং মল ও বিপণি-বিতানের সামনে সতর্কবাণী হিসাবে ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে মৃত্যুঝুঁকি আছে’ লেখা ব্যানার টানাতে হবে; ঠিক যেমন মোড়কের গায়ে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লিখে সিগারেটের প্যাকেট বিক্রি হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ওষুধ ও রফতানিমুখী পোশাক শিল্পকারখানা চালু রাখা যাবে। কিন্তু বন্ধ থাকবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন এবং আন্তজেলা চলাচল। শপিং মল আর পোশাক কারখানা খুলে দিয়ে একই প্রজ্ঞাপন আবার বলছে সবাইকে ঘরে থাকতে হবে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। হ-য-ব-র-ল আর কাকে বলে? ছোট্ট একটি প্রজ্ঞাপন; জন্ম দিয়েছে অসংখ্য প্রশ্নের।
১) এইবারের মতো ঈদ কি গত ১০০ বছরে এসেছে বিশ্বের বুকে?
২) সীমিত আকারে কথাটির অর্থ কী?
৩) চারপাশে যেখানে কেবল আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবর এবং প্রতিদিনের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তার আগের দিনের সংখ্যাকে, সেখানে অঘোষিত লকডাউনের কড়াকড়ি শিথিল করে কেন মার্কেট খোলার সিদ্ধান্ত?
৪) যেখানে ভিড়হীন রাস্তায় সামাজিক দূরত্ব আমরা রক্ষা করতে পারিনি, রাস্তায়, চায়ের দোকানে, যত্রতত্র দেখা গেছে মানুষের জটলা, সেখানে ঈদ শপিং হবে সামাজিক দূরত্ব মেনে?
৫) হাতেগোনা কিছু অভিজাত শপিং মল বাদ দিলে গাউসিয়া, হকার্স বা যেখানে সাধারণ মানুষ স্রোতের মতো ভিড় করে সেখানে সামাজিক দূরত্ব মানা কিংবা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা কি আদৌ সম্ভব?
৬) শপিং মলে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করবে কে? আর কেউ যদি না মানে, তাকে মানতে বাধ্য করবে কে এবং কীভাবে?
৭) শপিং মল, দোকান, গার্মেন্ট, শিল্প-কারখানা সবই যদি সরকারের ভাষায় ‘সীমিত আকারে’ খোলা হয় তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় কেন?
৮) তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই মানুষের জীবিকার কথা চিন্তা করে মার্কেট বা কারখানা খোলার অনুমতি দিচ্ছে সরকার, তাহলে প্রশ্ন ওঠে গণপরিবহন নয় কেন? গণপরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশার কথা প্রতিদিনই আসছে কোনও না কোনও গণমাধ্যমে।
৯) উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা সরকার পারলো না তার জনগণের দায়িত্ব মাত্র ৩ মাসের জন্য নিতে? জীবিকা বাঁচানোর নামে তাদের ঠেলে দিতে হলো মৃত্যুর দিকে? উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে বাংলাদেশ না সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে? পশ্চিমা দেশগুলোতো ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে তাদের নাগরিকদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
১০) ‘জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া বের হওয়া যাবে না; এই জরুরি প্রয়োজনটা ঠিক করবে কে? কারও কাছে হাসপাতাল যাওয়া জরুরি আবার কারও কাছে হয়তো মোড়ের দোকানে চা খাওয়া।
১১) দেশের এই কঠিন সময় এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত কারা নিয়েছে? সরকার কি রোগের গতি-প্রকৃতি, আক্রান্ত আর মৃতের পরিসংখ্যান বিচার-বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে এই সিদ্ধান্তে এসেছে নাকি সর্বোতভাবে আমলানির্ভর প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এটি?
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, যে দেশে সরকারি হিসাবে যেদিন আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার পার হলো সেদিনই ঘোষণা এলো শপিং মল খুলে দেওয়ার। মানুষ ছুটলো ইফতারির বাজারে। অথচ লকডাউন শিথিল করার বিষয়ে ছয়টি শর্ত পূরণ করার কথা বারবার বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেই ছয়টি শর্তের কয়টি পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ সরকার সেই বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
১) রোগ সংক্রমণ কি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে?
২) দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিটা রোগীকে শনাক্ত, পরীক্ষা, আইসোলেশন আর চিকিৎসায় এবং সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে?
৩) নার্সিং হোমের মতো সেবাকেন্দ্রগুলোর নাজুক স্থানগুলোয় ঝুঁকি কি নিম্নতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা গেছে?
৪) স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত ও অন্যান্য দরকারি স্থানে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা কি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি আমরা?
৫) বাইরে থেকে আসা নতুন রোগীদের পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ আর তত্ত্বাবধানে রাখার ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে করতে পেরেছি আমরা?
৬) সমাজের সব স্তরের মানুষদের পুরোপুরি সচেতন, সতর্ক ও নতুন জীবনযাপনের ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ করতে পেরেছি কি আমরা?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ চরম আকার ধারণ করতে পারে এবং পরবর্তী বেশ ক’দিন এই পরিস্থিতি স্থির থাকবে। চরম আকার কেমন হতে পারে তার কিছুটা আমরা দেখেছি আমেরিকা আর ইউরোপের কিছু দেশে। এবার আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদও আসছে মে মাসের শেষ সপ্তাহেই। অতীতে বহু ঈদ যেমন সাধ্যমতো উৎসব, আনন্দে পার করেছি, বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতেও ঈদ পালন করবো। কিন্তু সামনের ঈদ আপনার আর আপনার পরিবারের কেমন আসবে সেটি অনেকাংশে নির্ভর করবে এই ঈদ আপনি কেমন করে পালন করবেন। জীবন-জীবিকার দ্বন্দ্বের নামে সরকার জীবিকাকে প্রাধান্য দিতেই পারে কিন্তু এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে জীবন আর আড়ম্বরপূর্ণ উৎসবের মাঝে আপনি কোনটি বেছে নেবেন সেটি একান্তই আপনার বিবেচনা।
আশার কথা হলো, ঢাকায় নিউ মার্কেট, বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক ইতোমধ্যে না খোলার ঘোষণা দিয়েছে। সিলেটেও সব মার্কেট বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এরপরই চট্টগ্রামেও সব শপিং মল ও বিপণি বিতান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাজশাহীর সবচেয়ে বড় শপিং মল খুলবে ঈদের পর। আজ থেকেই দেশজুড়ে সীমিত পরিসরে শপিং মল ও বিপণি বিতান খোলার কথা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন মালিকরা। সিপিডির জরিপ বলছে, ৯৩ ভাগ মানুষই শপিং মল না খোলার পক্ষে। ২২৬৪ জনকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ২১০০ জনই মার্কেট খোলার বিপক্ষে মত দেন।
আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব আসলে শুরু হয় শবেবরাতের রাত থেকে। ঈদ কেবল একটি দিনের আনন্দ নয়, রোজার প্রতিটি দিন আনন্দ, অপেক্ষা আর প্রস্তুতিতে ঈদের বার্তা নিয়ে আসে। এবার সব ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম। তাই এবারের ঈদও আসবে না তার চিরচেনা রঙে। নতুন পোশাক, বাহারি জুতো, হাল ফ্যাশনের গয়নায় মোড়ানো ঈদ তো করলাম এত বছর। এবারের ঈদের আনন্দ হোক পরিবারের সবার সুস্থতা, একসঙ্গে মিলে বাড়িতে থেকে পরস্পরের সান্নিধ্যে নতুনভাবে ঈদ আবিষ্কার। একটি বিষয় মনে রাখা খুব জরুরি। রাষ্ট্রের কাছে আপনি হয়তো কেবলই একটি সংখ্যা মাত্র কিন্তু আপনার প্রিয়জনের কাছে আপনিই তাদের পৃথিবী। এবারের ঈদটা তাই এমনভাবে পালন করি যেন আগামীর ঈদগুলো ফিরে আসে চিরচেনা রঙে।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.