লীনা পারভীন:
নতুন বছরের প্রত্যাশা নিয়ে লেখা চাইলো জাগো নিউজ থেকে। ভাবতে বসলাম আমি। ২০২০ সালের শুরুতেও লিখেছিলাম নতুন বছরে আমি কী চাই বা কেমন বছর কামনা করি। কিন্তু তার কিছুই পাইনি। পাইনি বলাটাও কতটা যৌক্তিক? বাস্তবে একটি এলোমেলো বছর কাটিয়ে অনেকটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছি এখনও। ২০২০ গোটা বছরটাই খেয়ে নিলো করোনা নামক এক অজানা ভাইরাস। অনেক কিছুই করার ছিল, অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। হয়নি কিছুই।
নতুন বছরের রেজুলেশন বলে একটা বিষয় আছে। আমরা সবাই নতুন বছরে নিজেকে কেমন চাই লিখে থাকি। ব্যক্তিগত দিক থেকে বিবেচনা করলে খুব একটা “কনফিডেন্স” পাচ্ছিনা সামনের বছরের জন্য কিছু লিখতে। তারপরও আমি হতাশাবাদী মানুষ নই। আশায় বুক বাঁধি। নতুন বছরে করোনার হাত থেকে রক্ষা পাবে বিশ্ববাসী। আমরা আবার হৈ হুল্লোর আর প্রাণচাঞ্চল্যের জীবনে ফিরে যেতে পারবো। ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। শোনা যাচ্ছে নতুন বছরের শুরুর দিকে আমাদের দেশেও আসবে প্রত্যাশিত সেই “জিয়ন কাঠি”। হয়তো সাধারণ মানুষের নাগালে যেতে একটু সময় লাগবে তারপরও স্বপ্ন দেখি একদিন করোনার ছোবল থেকে আমরা বেঁচে যাবো।
২০২০ সালের বেশিরভাগ সময় বিশ্ববাসী কাটিয়েছে ঘরে বসে। জীবন জীবিকার দুনিয়ায় কালো ছায়া হানা দিয়েছিলো অনেকের। উন্নত বিশ্ব যেখানে হাবুডুবু খাচ্ছে করোনায় অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ঠিক তখন আমাদের মত একটি উন্নয়নশীল দেশ একটি শক্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ পিছনে ফেলেছে ভারতের মত একটি পরাক্রমশালী দক্ষিণ এশিয়ার দেশকে। মানবউন্নয়ন সূচকে এগিয়েছি আমরা। জীবন ও জীবিকার অনেক সূচকে এখন বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে রোল মডেল। করোনায় না খেয়ে মরেনি একজন ব্যক্তিও। এর কৃতিত্ব অবশ্যই আমাদের বর্তমান সরকারকে দিতেই হবে। করোনাকে মোকাবিলায় আমাদের নীতি একদিন বিশ্বের কাছে দুর্যোগ মোকাবিলার অনুকরণীয় কৌশল হবে।
একদিকে আশা জাগানো অর্থনীতি অন্যদিকে করোনা ঠেকাতে পারেনি নারী নির্যাতনের মত ঘটনা। করোনা আমাদের সবাইকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সম্পর্কের টানাপোড়েন আমাদেরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। পাশাপাশি বাসায় থেকেও মাসের পর মাস দেখা হয় না কারও সাথে। প্রিয়জনকে হারিয়ে অনেকেই আছে নিঃসঙ্গ অবস্থায়। মানসিক স্বাস্থ্য আজকে বিপর্যস্ত। অন্তত দুটি প্রজন্মের ভবিষ্যত হুমকির সম্মুখীন। শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে পুরোটাই। শিশুরা গৃহবন্দী থেকে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের মানসিক বিকাশের সুযোগ। বয়স্করা হাঁপিয়ে উঠেছে চারদেয়ালের মাঝে।
ভাবনার জগতটা পুরোটাই এলোমেলো অবস্থায় আছে। লিখতে বসে আমি নিজেই খেই হারিয়ে ফেলছি বারবার। কী লিখবো? কী চাইবো নতুন বছরের কাছে? ২০২১ কী আসলেই দিতে পারবে আমাকে কিছু? জানিনা। তারপরও লিখতে বসেছি। ভাবতে এখন আর ভালো লাগে না। লড়াই সংগ্রাম মানুষগুলো যেন লড়াইয়ের ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। এই অবস্থায় কি চলবে দুনিয়া?
ফিরে আসি দেশে। কী ঘটেছে আমাদের ২০২০ সালে? রাজনৈতিক ময়দানে তেমন কোন উত্থানপতন না থাকলেও মৌলবাদের আস্ফালন আমাদেরকে ভাবায়। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্ত্রী আর জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের কালে আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেছে মৌলবাদীরা। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছি আমরা ক্রমশ। কূপমণ্ডুক বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে আমাদের তরুণ সমাজ। দিনে দিনে আমরা যেন মগজহীন এক জাতিতে পরিণত হচ্ছি। ধর্মানুভূতির অজুহাতে মানুষকে পিটিয়ে, পুড়িয়ে মেরে ফেলছে।
কোথায় যেন আমরা দ্বিধায় থাকি। কষ্ট করে যাচাই করতে যাই না কিছুই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে মিথ্যা ও গুজবের রমরমা বাজার ছিলো ২০২০ সাল। মানুষের মাঝে দ্বিচারিতা বেড়েছে। মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্বের চেহারাটা। আমরা সবাই প্রত্যাশায় আছি কবে ২০২০ শেষ হয়ে ২০২১ আসবে। অনেকেই বলছে ক্যালেন্ডার থেকে যদি ২০২০ সালটি বাদ দিয়ে দেয়া যেত।
২০১৯ এর ৩১ ডিসেম্বর আমরা মহা ধুমধামে নতুন বছর আগমনের উৎসব করেছিলাম। কিন্তু এবার উৎসব পালনের সুযোগ নেই। মন খারাপ করেই হয়তো ঘরে বসেই ক্যালেন্ডার পাতাটাই কেবল পাল্টাবো আমরা। নেই কোন উৎসব, নেই কোন আয়োজন, আলোর ঝলকানি। কোন উৎসবই পালন করতে পারেনি বিশ্ব।
তাই ২০২১ সালের কাছে আমার প্রত্যাশা যেন আবার জেগে উঠতে পারে বিশ্ব। আবার আমরা স্বপ্ন দেখবো পাখির মত উড়ে বেড়ানোর। আবার কোলাহল করে গাইবো প্রাণ জুড়ানো গান। জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ে হেরে যাওয়া মানুষগুলো ফিরে পাবে বাঁচার আশা। দেশ থেকে দূর হয়ে যাবে উগ্রবাদের শ্লোগান। মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা কোন গোষ্ঠীকে আমরা আর আশ্রয় প্রশ্রয় দিবোনা। সফল অর্থনীতির পাশাপাশি দরকার একটি শক্ত সাংস্কৃতিক ভিত্তি। ধর্মের নামে আর কোন মানুষকে পুড়িয়ে মারা হবে না। হবে না কোন হানাহানি বা মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনা। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের শপথ থেকে যেন আমরা দূরে সরে না যাই। সোনার বাংলা গড়তে হলে মুক্তিযুদ্ধের নীতির কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই আমাদের।
এমন অসুখী পৃথিবী আমি আর দেখতে চাই না। আমার প্রিয় মানুষটিকে কাছে টানতে পারবো না, জড়িয়ে ধরে শান্তি নিতে পারবো না এমন দুনিয়ায় আমি থাকতে চাই না। আবার আমরা মিলবো একসাথে। ২০২১ এর কাছে আমার খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঠিক করেছি নতুন বছরে কেবল জীবনের জন্য বাঁচবো, জীবিকার জন্য নয়। তুমুল বাঁচবো। কষ্টে নয় হাসতে হাসতে বাঁচতে চাই। সকলকে নিয়ে, সকলকে ভালোবেসে ভয় ও শঙ্কাহীন, সুখকর একটি বছর কাটাতে চাই।
লেখক : কলামিস্ট।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.