ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
গবেষণায় বলা হয়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাতটি ইউনিটের সৃষ্ট বায়ু দুষণে আগামী ৩০ বছরে ১৮ হাজার থেকে ৩৪ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে
এক গবেষণায় দেখা গেছে, পটুয়াখালীর পায়রাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ রোগের ঝুঁকি বাড়বে।
গত ৫ মে দেশে প্রথম বারের মতো এ ধরণের গবেষণা প্রকাশিত হলো। গবেষণায় বলা হয়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাতটি ইউনিটের সৃষ্ট বায়ু দুষণে আগামী ৩০ বছরে ১৮ হাজার থেকে ৩৪ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা, সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ), এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) “এয়ার কোয়ালিটি, হেলথ অ্যান্ড টক্সিক ইমপ্যাক্ট অব দ্য প্রোপজড কোল পাওয়ার ক্লাস্টার ইন পায়রা, বাংলাদেশ” শিরোনামে যৌথভাবে গবেষণাটি সম্পন্ন করেছে।
পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইআইএ (পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন) রিপোর্টের তদন্তের পরে এই সমীক্ষা তৈরি করা হয়েছিল।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩০ বছরেরও বেশি জীবনকালে এর উচ্চতর নির্গমন ৩৩ হাজার ৬৩৬ মৃত্যুর কারণ হতে পারে যারমধ্যে ৪ হাজার ৯০০ জন ফুসফুসের রোগে, ১১ হাজার হার্টের রোগে, দুই হাজার ৭০০ জন শ্বাসকষ্টের কারণে (এরমধ্য ৩০০ শিশু), এক হাজার ৮০০ জন ফুসফুসের ক্যান্সারে এবং স্ট্রোকের কারণে ৮ হাজার ৯০০ জনের মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া আরও দুই হাজার ৪০০ জনের মৃত্যু হতে পারে নির্গমনকৃত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের কারণে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের অন্যান্য স্বাস্থ্যগত প্রভাবের মধ্যে ৭১ হাজার অ্যাজমা রোগী, ১৫ হাজার শিশুর হাঁপানি, ৩৯ হাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুর জন্ম হতে পারে। এছাড়া একইসঙ্গে দুই কোটি ৬০ লাখ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং ফুসের রোগজনিত প্রতিবন্ধীত্ব, ডায়বেটিস, স্ট্রোকে মতো রোগ ৫৭ হাজার বছর ধরে মানুষকে ভোগাবে।
তবে অল্প নির্গমন পরিস্থিতিতে, বায়ু দূষণের কারণে সম্ভব্য মৃত্যুর সংখ্যা ১৭ হাজার ৮৯৪ হতে পারে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সমীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. সুলতান আহমেদ বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে বায়ু দূষণ বা অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা কতটুকু সে বিষয়ে এটাকে খুব তাড়াতাড়ি মন্তব্য বলে অভিহিত করেন।
“পরিবেশ অধিদফতর প্রস্তাবিত মডেল এবং প্যারামিটারের ভিত্তিতে কোনো প্ল্যান্টকে ছাড়পত্র দেয়, যেখানে বায়ু দূষণের বিষয়টি নজরে রাখে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যদি প্রস্তাবিত প্রযুক্তির বাস্তবভিত্তিক ব্যবহার করে যা তারা ছাড়পত্রে উল্লেখ করেছে, তবে বৃহত্তর পরিমাণে দূষণের কোনো সম্ভাবনা নেই।”
এছাড়াও, কেন্দ্রটি উৎপাদনে গেলে পরিবেশগত মান বজায় রাখতে নজরদারি করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার পরই আমরা আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে এর প্রভাব বিশ্লেষণের পরে দূষণের বিষয়ে কথা বলতে পারি”, যোগ করেন সচিব।
এদিকে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এই গবেষণার বিষয়ে কিছু জানেন না জানিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
বায়ু দূষণ কোভিড-১৯ প্রকোপ বৃদ্ধি করতে পারে
গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস স্টাডি ২০১৭ অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ১১% ডায়বেটিস, ১৬% ফুসফুসের ক্যান্সার, ১৫% ফুসফুসের অন্যান্য রোগ, হার্টের অসুখে ১০% এবং ৬% স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেন।
বিভিন্ন গবেষণামূলক তথ্যের বরাত দিয়ে সিআরইএর শীর্ষ বিশ্লেষক লৌরি মেল্লিভার্টা বলেন, বায়ু দূষণের সংস্পর্শে মানুষ কোভিড-১৯ এর জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এটি এখন মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
গবেষণাটির বিষয়ে বাপা নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. আবদুল মতিন বলেন, “অতিমাত্রায় বায়ু দূষণের কারণে কোভিড-১৯ মহামারি আরও খারাপ আকার ধারণ করতে পারে। বায়ু দূষণের কারণেই ভবিষ্যতে এ জাতীয় আরও মহামারি দেখা দিতে পারে।”
সমীক্ষা অনুসারে, মোট ৯.৮ গিগাওয়াট ক্ষমতার মোট আটটি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রের খুব সাধারণ নির্গমনও একত্রে বাতাসের মানকে খারাপ করে তুলবে।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে সেনা কল্যাণ সংস্থা কর্তৃক নির্মিত একটি প্ল্যান্টকে গবেষণা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ ও অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি
সমীক্ষায় বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সাতটি ইউনিট প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ হাজার ৪৮০ টন হতে সবোর্চ্চ ৪৪ হাজার ৭৮০ টন সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) নির্গমন করবে।
এছাড়া প্রতি বছর ৫৫ হাজার ৯৫ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) এবং ছয় হাজার টন ছাই (fly ash) পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে। এরমধ্যে এক হাজার ৮১২ টন পিএম ২.৫ হবে, যা ফুসফুস এবং শ্বাসযন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে।
এটি ঢাকা ও সুন্দবরবন এলাকাসহ পিপিএম ২.৫ বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হবে, এছাড়া নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড দূষণ পিপিএম ২.৫ এর চেয়ে বেশি এলাকায় যেমন ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
গবেষণায় দাবি করা হয়ে, এই প্রকল্প থেকে প্রতি বছর আনুমানিক ৬০০-৮০০ কেজি পারদ বাতাসে নির্গত করবে, যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের ভূমি এবং মিঠা পানির বাস্তুতন্ত্রে জমা হবে। এতে বিশেষত ফসলি জমি এবং মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
ইলিশের ওপর প্রভাব
দেশে ইলিশ মাছের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য রয়েছে, এরমধ্যে পায়রা এলাকায় মাছটির ডিম ছাড়া ও বিচরণক্ষেত্র রয়েছে, এক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত পারদ ইলিশের জীবনচক্রে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ফিশারি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পারদ নির্গমন জাতীয় মাছের জন্য সবচেয়ে সমস্যাজনক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, পারদ জমার পরিমাণ এত বেশি যে এটি ইলিশ খাওয়া বা বিক্রির ক্ষেত্রে বিষাক্ত করে তুলতে পারে।
“এমনকি প্রতিবছর হেক্টর প্রতি পারদ জমার হার ১২৫ মিলিগ্রাম হলেও সেটি মাছের ক্ষেত্রে অনিরাপদ মাত্রা জড়িত পরিচিত,” তিনি যোগ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ডা. মো. মনজুরুল কিবরিয়ার ধারণা, অনুমিত নির্গমন পায়রার আশেপাশের অভয়ারণ্যে ইলিশ প্রজননকে ব্যাহত করতে পারে।
মিনামাতা কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পারদ বর্হিভূত পণ্য তৈরি করা উচিত
মিনামাতা কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশে হিসেবে, বাংলাদেশ ২০২৫ সাল পর্যন্ত পারদ বর্হিভূত পণ্য এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পারদ ও এর বিভিন্ন যৌগ মানুষের উপর মারাত্মক স্বাস্থ্যগত প্রভাব ফেলে। এগুলেঅ স্নায়বিক এবং পাচনতন্ত্রের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ও কিডনির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভুক্তভোগীরা এসব সমস্যার পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং অসংলগ্ন কথাবার্তার সমস্যায় পড়তে পারে।
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (ইএসডিও) সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, যে কোনও রূপে পারদ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক।
তিনি বলেন, “পারদ খাদ্য শৃঙ্খল, শ্বাস গ্রহণ ও পানির মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। এটি ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে।”
মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিকে এড়াতে দ্রুত পারদ নির্গমন উত্স হ্রাস করার দাবি জানান শাহরিয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখনও মিনামাতা কনভেনশনকে অনুমোদন দেয়নি। তবে স্বাক্ষরকারী হিসাবে দেশটির এই সনদ মেনে চলা উচিত।”
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম তামিম বলেন, ২০১৬ সালের মাস্টার প্ল্যানের তুলনায় ২০১০ মাস্টার প্লানে সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস করতে চেয়েছিল।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ আরও কমে আসবে। সরকার আগামী দিনগুলোতে এলএনজিসহ (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর জোর দেবে। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী কয়লা ভিত্তিক বিদুৎ উৎপাদন হ্রাস করার প্রবণতা চলছে।”
তবে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এই মুহূর্তে গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত যে সরকার প্রচুর পরিমাণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে তার অবস্থান সরিয়ে নেবে। এটা যদি করা হয় তবে দূষণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাস পাবে।” সূত্র:বাংলাট্রিবিউন।
ভয়েস/জেইউ।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.