প্রভাষ আমিন:
ব্যাঙ আর শিশুদের খেলার গল্পটা আপনাদের সবার জানা। পুকুর পাড়ে কয়েক শিশু খেলছিল। তারা পুকুরে ঢিল ছুড়ছিল। তাতে মারা যাচ্ছিল ব্যাঙ। একটি বয়স্ক ব্যাঙ সাহস করে মাথা উঁচিয়ে বললো, শিশুরা তোমাদের জন্য যেটা খেলা, আমাদের জন্য সেটা মৃত্যু। এমন কত মৃত্যু খেলা আমরা প্রতিদিন খেলি। বিভিন্ন পেশার মানুষের একটু খামখেয়ালি, একটু ভুল, একটু অবহেলায় অন্য অনেকের জন্য মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। পুলিশ হাসতে হাসতে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলে। ডাক্তারদের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় মারা যায় অনেক রোগী। সাংবাদিকদের ভুল বা খামখেয়ালিতে জান না গেলেও মান যায় অনেকের। কখনো কখনো সামাজিক মর্যাদা কারও কারও কাছে জীবনের চেয়েও মূল্যবান।
অন্য পেশার কথা আপাতত তোলা থাক। নিজেদের একটি ভুলের কথাই বলি। একাধিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া পিকে হালদার তার বান্ধবীদের কাছে গচ্ছিত রেখেছেন মেরে দেয়া টাকার বড় একটা অংশ। তেমনি এক বান্ধবীর খোঁজ মেলে গত সপ্তাহে। অবন্তিকা বড়াল নামে পিকে হালদারের সেই বান্ধবীকে চেনেন না তেমন কেউ। কিন্তু সাংবাদিকদের নিউজ করার জন্য একটা ছবি দরকার। এখন ছবির বড় উৎস গুগল। সেখানে খুঁজলে অনেকের ছবিই পাওয়া যায়। তেমন কেউ হয়তো ‘অবন্তিকা বড়াল’ লিখে গুগলে সার্চ দিয়েছিলেন।
গুগল সার্চ দিলে চেনা-অচেনা অনেকের ছবিই সাজেশন হিসেবে আসে। সেই সাংবাদিক হয়তো না চিনেই, অন্য এক নারীর ছবি অবন্তিকা বড়াল হিসেবে চালিয়ে দেন। তারপর সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। একাধিক টিভি চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইন ভুল নারীর ছবি ‘অবন্তিকা বড়াল’ বলে চালিয়ে দেয়। ভুলটা বোঝার সাথে সাথে অবশ্য অনেকেই সংশোধন করে ফেলেছেন। কিন্তু তাও এখন ভার্চুয়াল জগতে অবন্তিকা বড়াল হিসেবে ভুল নারীর ছবি ভেসে বেরাচ্ছে। এখন ভাবুন একবার সেই নারীর কথা। কোনো সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও সেই নারীকে পিকে হালদারের বান্ধবীর কলঙ্ক বইতে হচ্ছে।
পরিচিতরা না হয় বুঝবেন। কিন্তু তিনি তো আর জনে জনে গিয়ে বোঝাতে পারবেন না যে এটা ভুল। একজন মানুষও যদি ছবি দেখে ভুল করে তাকে পিকে হালদারের বান্ধবী মনে করে, তাহলে সেই ক্ষতির কী পূরণ হবে? নারী-পুরুষ সবার জন্যই সামাজিক মর্যাদাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় একজন নারীর মর্যাদা অনেক স্পর্শকাতর বিষয়। এমনিতেই বিশাল ভার্চুয়াল জগতে নারীর জন্য নানা ফাঁদ পাতা থাকে। নানাভাবে তাদের হয়রানি করা হয়, করা যায়। কিন্তু কোনোরকমের সম্পৃক্ততা ছাড়াই একজন নারীর হেনস্থা বেদনাদায়কই বটে। আমি ছাপোষা সাংবাদিক। আমি হয়তো তার বেদনার উপশম করতে পারবো না। কিন্তু তার বেদনায় আমি তার পাশে আছি, তার প্রতিবাদে আমি তার পক্ষে থাকব।
সাংবাদিকের হাতে কলম মানে মসি আছে। মসি কখনো কখনো অসির চেয়েও বিপজ্জনক। একবার যদি আপনি কিছু লিখে ফেলেন বা প্রচার করে ফেলেন; শত চেষ্টায়ও তার প্রভাব পুরো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ধরুন পত্রিকায় একটি ভুল নিউজ বা ছবি ছাপা হলো। পরদিন প্রতিবাদও ছাপা হলো। কিন্তু মূল নিউজ বা ছবি যেখানে ছাপা হয়, প্রতিবাদ তো আর সেখানে ছাপা হয় না। প্রথমদিনের ভুল নিউজটি যিনি পড়েছেন, পরদিন প্রতিবাদটি তার নজর এড়িয়ে যেতে পারে। তাই সেই পাঠকের স্মৃতিতে কিন্তু ভুল নিউজটিই থেকে যাবে। অনলাইনে তো লিঙ্ক মুছে ফেললেও স্ক্রিনশট থেকে যায়। টেলিভিশনের সমস্যা তো আরো বেশি। একবার অনএয়ার হয়ে গেলে মানুষের স্মৃতি থেকে তা মুছে ফেলা কঠিন।
এতো গেল ভুলের কথা। কিন্তু যদি কোনো সাংবাদিক জেনেশুনে কাউকে হেয় করার জন্য মিথ্যা নিউজ প্রচার করেন, তার কী হবে? অনিচ্ছায় বা ইচ্ছায় মানুষকে হেয় করার, চরিত্রহননের, মর্যাদাহানির এমন অনেক ঘটনা কিন্তু অহরহ ঘটে। যারা ইচ্ছা করে করেন, তাদের তো আমি সাংবাদিকই মনে করি না। তারা সাংবাদিকতার নামে ধান্দাবাজি করেন, চাঁদাবাজি করেন। এমন ধান্দাবাজের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। কিন্তু যারা পেশাদার সাংবাদিক, তারাও মাঝে মাঝে ভুল করেন। তেমনই একটি হয়তো অবন্তিকা বড়ালের ভুল ছবি প্রচার হওয়ার ঘটনা। এটা অদক্ষতা হতে পারে, ভুল হতে পারে, অপেশাদারিত্ব হতে পারে, খামখেয়ালি হতে পারে।
যাই হোক, তাতো সেই ব্যাঙের মতো, কারও কারও জীবনের ওপর আঘাতের মতো। তাই সাংবাদিকদের প্রত্যেকটি অক্ষর লেখার আগে বা কোনো ছবি ছাপার আগে তার সত্যাসত্য যাচাই করতে হবে। প্রয়োজনে একাধিকবার যাচাই করতে হবে। ভুল নিউজ বা ছপি ছাপার চেয়ে না ছাপা অনেক ভালো। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমে এখন এমন একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে, কে কার আগে নিউজ দেবে, এ নিয়ে হুড়োহুড়ি। নিউজ বা ছবি ছাপার আগে কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে, এটা সাংবাদিকতার প্রাথমিক পাঠ। কিন্তু প্রতিযোগিতার মাঠে আমরা সেই পাঠ মাঝে মাঝে ভুলে যাই। তবে ভুল থেকে যেন আমরা শিক্ষা নেই যে, ভবিষ্যতে যাচাই ছাড়া কোনো নিউজ বা ছবি ছাপবো না।
যারা ইচ্ছা করে মানুষকে হেয় করে, মিথ্যা নিউজ ছাপে; তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সাংবাদিক ইউনিয়নও ব্যবস্থা নিতে পারে। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। যাতে অনিচ্ছায় ভুলের সংখ্যা কমে আসে। সংখ্যাটা শূন্যে নামিয়ে আনা পর্যন্ত আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আমাদের হাতে কলম আছে। কিন্তু যা ইচ্ছা তাই লেখা বা প্রচার করার অধিকার নেই। যেহেতু আমার কলম অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে, তাই আমাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এবং সেই সতর্কটা সার্বক্ষণিক। কোনো ঢিল দেয়ার সুযোগ নেই। একটু ঢিলেমিতে একজন মানুষ অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.