আবদুল আজিজ, মিনঝিড়ি পাড়া থেকে ফিরে:
পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের অজপাড়া একটি গ্রামের নাম মিনঝিড়ি পাড়া। উচু-নিচু অরণ্যঘেরা পাহাড় ভেদ করে বয়ে চলা মাতামুহুরী নদীর পাশে ৪৪টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে রাখাইন পল্লী মিনঝিড়ি পাড়া। গ্রামটির রাখাইনদের একমাত্র ভরসাস্থল পাহাড়ে কাঠ কেটে বিক্রি, পাহাড়ে ফসল উৎপাদন ও শুস্ক মৌসুমে মাতামহুরী নদীতে মাছ শিকার সহ নানা প্রচেষ্টায় জীবিকা নির্বাহ করা। শত বছর ধরে বসবাসরত রাখাইন অধিবাসীদের কোন ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। উন্নয়ন বঞ্চিত এসব রাখাইন পরিবার গুলো দিনের পর দিন সরকারি সব সুবিধা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। রাস্তাঘাট তো দূরের কথা, নেই কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নেই কোন বিদ্যুৎ সুবিধা। একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম মাতামুহুরী নদীর পথ। নৌকা করে যাতায়াতের মাধ্যম হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্ধ থাকে দিনের পর দিন এবং মাসের পর মাস। কবে এই গ্রামের উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে জানেন না এসব রাখাইন অধিবাসিরা।
মিনঝিড়ি পাড়া গ্রামে ৭০ বছরের অধিক সময় ধরে বসবাস করে আসছেন চাতিং গ্রু চাকমা। এক সময় শান্তি বাহিনীর সদস্য ছিলেন। শান্তি বাহিনীতে যোগদানের পর বাম পা হারিয়ে এখন পঙ্গু। একদিকে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তি, অন্যদিকে নিজের অঙ্গ হারিয়ে এখন বেকার।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ চাতিং প্রু চাকমা (৭০) জানান দু:খ-কষ্টের জীবনের গল্প। শেষ বয়সে এসে সংসার জীবনের একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী চ্যাং ক্য চাকমা (৬০)। লাঠির উপর ভর করে চলা এই রাখাইন বৃদ্ধ স্ত্রীর সহযোগিতায় বাঁশের তৈরী বিভিন্ন সরঞ্জামাদি বিক্রি করে কোন রকমের সংসার। তার বাপ-দাদা জন্মভূমি এই মিনঝিড়ি পাড়াতেই। কিন্তু, জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন ধরণের অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। সরকারের সব ধরণের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নেই বিদ্যুৎ, নেই রাস্তাঘাট। নেই কোন চিকিৎসা সেবা। সরকারির বয়স্কভাতা থেকেও বঞ্চিত এই রাখাইনপল্লীর মানুষ। দিনে এনে দিনে খায় দাদনের উপর ভর করে। তিনি জানেন না এই মিনঝিড়ি পাড়া কবে উন্নয়ন হবে।
স্বামীর সঙ্গে মাতামুহুরী নদীর পাড়ে দাড়িয়ে ছিলেন স্ত্রী চ্যাং ক্য চাকমা। তিনি জানান, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই রাখাইন পল্লীতে বেড়ে উঠছে। কিন্তু, ধর্মীয় কাজের জন্য একটি মাত্র বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। এই বিহারে প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা লাভের পর উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগ নেই।
মং অ্যা থ্যাং চাকমা (৪১)। স্ত্রী সহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫জন। ছেলে/মেয়েরা লেখাপড়া করে না। পাহাড়ে কাঠ কেটে সংসার। উপযুক্ত ছেলে/মেয়ে আমার সাথে পাহাড়ে কাঠ সংগ্রহ করতে যায়। কাঠ বিক্রি করে সংসার চলে। পাহাড়ে সামান্য জুম চাষ হয়। তা দিয়ে চলে দুয়েক মাস। মাতামুহুরী নদীর পাড়ে তামাক চাষের দাদন নিয়ে সীমাহীন কষ্টে জীবন চলে। নদীরপাড়ের জমি গুলোতে এক সময় বিভিন্ন শাকসবজির আবাদ হলেও এখন তামাক চাষ হয় জমি গুলোতে। এই তামাক চাষ আমাদের কাল হয়ে দাড়িয়েছে।
লামা উপজেলাতে হোষ্টেলে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন রাখাইন শিক্ষার্থী চৈতিং চ চাকমা (১৫)। তিনি জানান, মিনঝিড়ি পাড়ায় কোন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। এনজিও ব্রাক একটি শিশু শিক্ষা নিকেতন রয়েছে। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকলেও অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। বিদ্যালয়ে যেতে হলে লামা উপজেলা ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান নেই। এই লামায় পৌছতে মাতামুহুরী নদীপথে নৌকায় সময় যায় ২ ঘন্টা। তাও বর্ষার সময়ে আসা-যাওয়া কঠিন। তাই আমি লামায় হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি এখন নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। আমার ইচ্ছা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। করোনায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আমি হোস্টেল থেকে আমার গ্রাম মিনঝিড়ি পাড়ায় বাড়িতে এসেছি। প্রতিষ্ঠান চালু হলে আবারও চলে যাব। এই গ্রামের অধিকাংশ ছেলে/মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আমি চাই সরকারিভাবে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হউক।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.