শাহীন হাসনাত:
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১৪ এপ্রিল পবিত্র রমজান শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজার বেসামাল হতে শুরু করেছে। কোনো কিছুর দাম একবার বাড়লে আর কমে না। পরিবহন সেক্টরের মতোই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সর্বসাধারণ যেন অসহায়। দেশের পরিস্থিতি এমন যে, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের উচ্চদামে পণ্যক্রয়ের কষ্ট বোঝার কেউ নেই। মধ্যবিত্তরা সরকারি অনুদান চান না। তারা চান, সরকার সাধারণ জনগণের কষ্টের কথা ভেবে পণ্যের দাম হাতের নাগালে রাখুক। তারা যেমন বাজারের ব্যাগ নিয়ে টিসিবির পণ্য কেনার লাইনে দাঁড়াতে পারেন না, তেমনি বাজারে গিয়ে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে কিনতে পারেন না। এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে তারা মুক্তি চান। বলতে দ্বিধা নেই, সরকারি চাকরির বাইরে দেশের সাধারণ জনগণের অবস্থা অনেকটা এমনই। সুতরাং এই শ্রেণির লোকদের জীবনযাত্রার কথা, কষ্ট ও যন্ত্রণার কথা সংশ্লিষ্টদের মাথায় রাখতে হবে।
পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় কোনো উপলক্ষ কিংবা দেশীয় উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে। উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছাড়ের হিড়িক পড়ে যায়। অনেকে বছরজুড়ে এ সময়টার জন্য অপেক্ষা করে। সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখে তারা। ছাড় আর সেলের এ রীতি দুনিয়াজোড়া স্বীকৃত, ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ! এখানে সবরকম উৎসবের আগে পণ্যের দাম বাড়ে। গুজবে বাজারে সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সারা বছরই ভেজাল মিশিয়ে কিংবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ক্রেতাসাধারণের পকেট কাটেন। রোজার সময় তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাবে তারা মুনাফা শিকারে চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাদের অতি মুনাফালোভী মনোবৃত্তির কারণে রমজানে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
অথচ সব মুসলিম রাষ্ট্রে রমজান মাসে পণ্যের দাম কমাতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আমাদের দেশে কিন্তু পুরো উল্টো চিত্র। অন্য মুসলিম দেশের ব্যবসায়ীরা ১১ মাস ব্যবসা করে রোজার মাসে পণ্যের দাম কমিয়ে রোজাদারদের সেবা করেন। রমজানে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, কুয়েত, কাতার ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে জিনিসপত্রের মূল্য কমিয়ে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ও অফার দিয়ে থাকে। ওরাও মুসলমান আমরাও মুসলমান, বিষয়টা ভাবাও লজ্জার কারণ। আসবে রোজা বাড়বে দাম, এটাই বাংলাদেশের ৫০ বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
রোজা এলেই কেন জিনিসপত্রের দাম বাড়বে? এ তো জানা কথাই যে, রোজায় কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। এর মধ্যে আছে পেঁয়াজ, ছোলা, ডাল, চিনি, দুধ, তেল, আটা, মুড়ি, খেজুর, আলু, বেগুন, শসা ইত্যাদি। এসব পণ্য কী পরিমাণ লাগবে, তাও আমাদের জানা। তাহলে আগেভাগেই কেন আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না। নির্দিষ্ট একটি পণ্য দেশে কতটুকু আছে, কতটুকু উৎপাদিত হয়েছে, বাড়তি কতটুকু আমদানি করতে হবে, তার হিসাব কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অবশ্যই থাকতে হবে। প্রতি বছরই তাহলে কেন এ অনিয়ম? এ ধারা কি যুগ যুগ ধরে চলতেই থাকবে? এর কি কোনোই সুরাহা নেই?
বাংলাদেশে অনেক দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবার দরিদ্রতার গ্লানি থেকে বেরুতে পারছে না শুধুমাত্র নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য ও চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে। মানুষ যেকোনো কিছুর বিনিময়ে পরিবারের সদস্যদের সুস্থ দেখতে চায়, কিন্তু দেশে খাদ্যের দাম-মান, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং পরিবেশ দূষণের প্রভাব এত বেশি যে, সুস্থ থাকাটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বর্তমানে আমরা যে উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তার উৎস শুধু কভিড নাইনটিন নয়, বরং আরও একটি মহামারী। করোনায় আক্রান্ত ও বিয়োগান্তের মতো সেই উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- ‘পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মহামারী।’ বর্তমানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মেরুকরণ দ্বারাই বেশি আক্রান্ত সাধারণ মানুষ।
মুনাফা অর্জন ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক নীতি। এটা তাকে করতেই হবে, তাতে কারও কোনো আপত্তি নেই; থাকতে পারে না। কিন্তু জনগণকে জিম্মি করে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন ব্যবসার নীতি হতে পারে না। রমজানের অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে সংযম। জীবনের সব ক্ষেত্রে সংযমী হওয়াই রমজানের শিক্ষা। সংযম লাভের উদ্দেশে রোজা পালন করা হয় ইবাদত হিসেবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে যদি এর উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হয়, তাহলে এই রোজার কোনো ফায়দা হবে না। এসবের দ্বারা প্রকারান্তরে ওই সব ব্যবসায়ী রমজানের বিরুদ্ধে, রমজানের চেতনার বিরুদ্ধে, রমজানের শাশ্বত শিক্ষার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়। কারণ অহেতুক জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে তারা রোজাদারদের কষ্ট দেয়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘সত্যিকারের মুসলিম কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেয় না।’
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরি, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
তাই সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ক্রমবর্ধমান চাপ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। এ জন্য দেশের মজুদদারি, পণ্যের কৃত্রিম সংকট ও চোরাচালানি-কালোবাজারি রোধ করতে হবে সবারদ আগে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে আরও কঠোর ও দায়িত্বশীল। শুধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ আর গালভরা আশ্বাস নয়, আমরা চাই কার্যকর পদক্ষেপ। যে পদক্ষেপের কারণে মানুষ একটু স্বস্তির সঙ্গে রোজাগুলো পালন করতে পারবে।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.