ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ১০ম সপ্তাহ চলছে। এ সপ্তাহে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা আগের দুই সপ্তাহের তুলনায় ৩০ জন বেশি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সলুতানা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন শিথিল করার পর মানুষের আনাগোনা ও জনসমাগম বেড়ে গেছে। মানুষকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হতে নিষেধ করা হলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। ‘জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া বের না হওয়ার গুরুত্ব বুঝতে হবে। তা না হলে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।
জানা যায়, গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের দুই মাস পর গত ১১ মে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের সংখ্যা প্রথম এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ১২ মে শনাক্ত হন ৯৬৯ জন, ১৩ মে এক হাজার ১৬২ জন, ১৪ মে এক হাজার ৪১ জন এবং ১৫ মে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক এক হাজার ২০২ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। এখন পর্যন্ত দেশে মোট করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২০ হাজার ৬৫ জন। ৮ মার্চ রোগী শনাক্ত হওয়ার ৬৯তম দিনে এসে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগী ২০ হাজার ছাড়ালো। আর মারা গেছেন ২৯৮ জন।
১৫ মে মারা যাওয়া ১৫ জনের মধ্যে ঢাকার সাত জন, নারায়ণগঞ্জের দুই জন, কেরানীগঞ্জের একজন, চট্টগ্রামের তিন জন এবং নেত্রকোনা ও সিরাজগঞ্জের একজন করে রয়েছেন।
গত ১০ মে থেকে দোকানপাট, শপিং মল সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। আগে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাইরে থাকার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ৬ মে থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাইরে থাকার সময় বাড়ানো হয়। এতে করে মানুষের ঘরের বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে বের হয়ে আসছেন বাইরে। এভাবে জরুরি প্রয়োজনের বিষয়টি গুরুত্ব হারালে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
গত ৫ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পর পোশাক কারখানা খোলা এবং দোকানপাটে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'আমাদের সংক্রমণ বাড়ছে, গত ৮-১০ দিন ধরে দেখছি, চার থেকে পাঁচশ’ রোগী হতো, কিন্তু এখন ছয়শ’ ছাড়িয়ে গেছে, আজ সাতশ’ ছাড়িয়েছে। এখন মার্কেট খোলা হয়েছে, গার্মেন্টস খোলা হয়েছে, দোকানপাটে আনাগোনা বাড়ছে; কাজেই সংক্রমণ যে একটু বৃদ্ধি পাবে, এটা আমরা ধরেই নিতে পারি।’
গত ১৪ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'মানুষের জীবিকার তাগিদে সরকারকেও সীমিত পরিসরে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা খুলে দিতে হয়েছে। এসব কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও কিছুটা বৃদ্ধি পাচ্ছে, হয়তো আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকাগুলোতে পোশাক কারখানা, দোকানপাট খোলা হলো। অর্থাৎ লকডাউন শিথিল করা হলো। ঈদকে সামনে রেখে জনসমাগম বাড়ছে। এটা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকির প্রতিফলন প্রতিদিনের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে। আর তাই ‘জরুরি প্রয়োজন’ এর গুরুত্ব মানুষকে বুঝতে হবে।'
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'গত তিন-চার দিন পরীক্ষায় শতকরা ১৪ শতাংশের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মানে শনাক্তের হারের ট্রেন্ড ঊর্ধ্বমুখী। রোগীর সংখ্যা এবং মৃতের সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় বেশি।'
'জরুরি প্রয়োজনের জন্য যেসব দোকানপাট খোলা ছিল—সেটা ঠিক ছিল। কিন্তু ঈদের জন্য দোকান খোলা হয়েছে—এটা প্রত্যাহার করতে হবে। লকডাউন ফিরিয়ে আনতে হবে।'—বলেন মুশতাক হোসেন।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'গত ৭ মে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, দোকানপাট খোলা ও মসজিদে নামাজ পড়া চলমান থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের পক্ষ থেকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিয়ে বলা হয়েছে, দেশে সংক্রমণের হার উর্ধ্বমুখী। লকডাউন শিথিলের পর নিম্নমুখী না হয়ে গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণে বলা হয়েছে, লকডাউন আরও শিথিল করা হলে, সংক্রমণ আরও বাড়বে। সরকারকে অনেক কিছু বিবেচনা করতে গিয়ে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে বলে আমার ধারণা।'
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি আরও বলেন, ‘সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী, একে আরও পরিষ্কার করে বোঝার জন্য টেস্টের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। ১০ থেকে ১৫ হাজার করা উচিত। আর ভবিষ্যতে একে ২০ থেকে ৩০ হাজারে করা যায় কিনা, সে বিষয়েও প্রস্তুতি নিতে হবে। একইসঙ্গে ফলাফল যেন ২৪ ঘণ্টার ভেতরে দেওয়া যায়, সে বিষয়েও নজর দিতে হবে।'
এখনও যাত্রীবাহী ট্রেন-বাস চালু হয়নি মন্তব্য করে অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলেন, 'নরমালি অফিস-আদালত বন্ধ রাখা হয়েছে—এটা যেন কঠোরভাবে মানা হয়। যেটুকু শিথিল হয়েছে, তাতে আর এখন কিছু করার নেই। তবে শপিং মলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মানা হলে ক্রেতা এবং বিক্রেতা দু’জনকেই শাস্তির আওতায় আনা হলে, সেখান থেকে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া যাবে।'
জেলাভিত্তিক করোনা রোগীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এখন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত মন্তব্য করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. এম মুজাহেরুল হক বলেন, 'সংক্রমণ রোধে যেখানে ১০ জন রোগী রয়েছে সেটাকে গ্রিন জোন, ১০-১০০ রোগীর জেলাকে ইয়োলো এবং ১০০ এর বেশি রোগী থাকলে সেই এলাকাকে রেড জোনে ভাগ করে তিন ধরনের কৌশল নিতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিন্ময় দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'শুরু থেকেই পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং ব্যবস্থাপনায় গলদ ছিল। তারপরও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং গাজীপুরকে যদি এই মুহুর্তে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায় তাহলেও পেছনে না হটে এখান থেকে শুরু করা যায়।'
তিনি বলেন, 'এখনও দেশে মৃত্যুর হার অনেক কম আছে। তবে খুব কঠোর জায়গাতে আসা উচিত, অন্তত ঈদ পরবর্তী সময় পর্যন্ত।'
চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী আতিক আহসান মনে করেন, শপিং মল খুলে দেওয়া আসলে বর্তমানের রোগী বাড়ার প্রতিফলন নয়। সাধারণ ছুটি শিথিল করে শপিং মল খুলে দেওয়ার ইফেক্ট আসতে ১৪ থেকে ২১ দিন সময় লাগবে। হয়তো আগামী ২৫ মে থেকে এই আক্রান্তের হার আরও বাড়বে। এ সপ্তাহে রোগী বাড়ার কারণ পোশাক কারখানা শ্রমিকদের ঢাকায় আসা-যাওয়া করা। যদি লকডাউন চালু থাকতো তাহলে এই হারে রোগী বাড়তো না। লকডাউন কঠোরভাবে মানা হলে ২১ মে-এর পর থেকে রোগী বাড়ার হার পর্যায়ক্রমে নামতে থাকতো।
'এখন তাই যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে টেস্ট-ট্রেস এবং আইসোলেশন করতে হবে, আর এর ওপরই নির্ভর করছে কত দ্রুত এই আউটব্রেক নিয়ন্ত্রণ করা যায়।'—বলেন আতিক আহসান।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.