এ কে এম খাদেমুল হক :
নব্বইয়ের দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, এলিফ্যান্ট রোডের দুটি দোকান থেকে জামা-কাপড় কিনতাম আমরা অনেকেই। কেনার অন্যতম কারণ, সারা বছর দোকান দুটিতে ‘মূল্য হ্রাস’ লেগেই থাকত। তবে খুব সম্ভব সেই ‘মূল্য হ্রাস’র ঘোষণাটা হতো অর্থহীন এবং আমার মতো অনেকেই সেটা জানত। সে কারণেই কি না, কদিন পরপর নিত্য-নতুন নামে মূল্য হ্রাসের পোস্টার লাগাত তারা। কখনো ভূমিকম্প, কখনো ঝড়ের মতো মূল্য হ্রাস দিয়েও যখন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা যাচ্ছিল না, তখন একবার তারা লিখতে শুরু করল, ‘আখেরি মূল্য হ্রাস’।
রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের লোকাল বাসগুলো ছিল আরেক কাঠি সরেস। ‘গেটলক’ ঘোষণা দিয়ে নিয়মিতই যত্র-তত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো বাসগুলোর ‘গেটলক’ ঘোষণা কেউ বিশ্বাস করত না বলে একসময় তাদের মধ্যে কোনো কোনোটির মালিকরা সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন, ‘আল্লার কসম গেটলক’।
কভিড-১৯ অতিমারী ঠেকাতে বাংলাদেশে এক বছর ধরে ‘লকডাউন’-এর নামে যা হচ্ছে, তা দেখে মনে পড়ে গেল কথাগুলো। সরকার অবশ্য ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার করছে না আনুষ্ঠানিকভাবে। কিন্তু মিডিয়ার শিরোনামে তো বটেই, কথা বলতে ভালোবাসেন এমন মন্ত্রীদের মুখেও চীন দেশে আবির্ভূত এই ভাইরাস ঠেকাতে চীনাদেরই আবিষ্কৃত মানুষকে ঘরবন্দি রাখার টোটকার ইংরেজি নামটা শোনা যাচ্ছে হামেশাই। গত বছরের মার্চে সরকারের ভাষায় ‘সাধারণ ছুটি’ আর মিডিয়ার ভাষায় ‘লকডাউন’ শুরু হয়েছিল বেশ কড়াকড়ি নিয়েই। কিন্তু সেই বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো খুলে যেতে বেশি সময় লাগেনি। অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ভাবনায় একসময় সরকারকে তুলে নিতে হয়েছিল সব বিধিনিষেধ, একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া খুলে গিয়েছিল সবকিছুই। ব্যাখ্যাতীত কোনো একটা কারণে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের আক্রমণের প্রথম ঢেউটা তেমন ক্ষতিও করতে পারেনি এ দেশের মানুষের; তার ওপর অন্য অনেক দেশের চেয়ে আগে এবং প্রশংসনীয় ব্যবস্থাপনায় ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু হয়ে যাওয়ায় আমরা যেন আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে শুরু করেছিলাম। ঠিক সেই সময় ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা এই ভাইরাসের বদলে যাওয়া নতুন দুটি রূপ দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে প্রবল শক্তিতে আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। ফলে বাধ্য হয়েই আবারও মানুষকে গৃহবন্দি রাখার কথা ভাবতে হচ্ছে। গত ৬ এপ্রিল থেকে প্রথমে এক সপ্তাহের জন্য কিছু ‘বিধিনিষেধ’ জারি করেছিল সরকার, যথারীতি যেটাকে সবাই বলছিলেন ‘লকডাউন’। এখন শুনছি, আরও কঠিন বিধিনিষেধ নাকি আসতে যাচ্ছে, মিডিয়ার ভাষায়, ‘কঠোর লকডাউন’।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাধারণ ছুটি, বিধিনিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডাউন যে নামেই একে ডাকি না কেন, বীর বাঙালিকে সেটা মানানো প্রায় অসম্ভবেরই কাছাকাছি। কারণ? সবচেয়ে বড় কারণ বোধ হয় আইন বা বিধিনিষেধ মানার প্রতি স্বভাব-বিপ্লবী বাঙালির প্রবল অনীহা। এ দেশের মানুষ ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে সরকারের পিণ্ডি চটকায়, কিন্তু সামান্যতম সুযোগ পেলে সিগন্যাল ভেঙে বা উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে দেয়; সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকের মৃত্যুদন্ড চেয়ে আন্দোলন করে, কিন্তু দশ কদম হেঁটে ওভারব্রিজে না উঠে ব্যস্ত রাস্তার উঁচু বিভাজক টপকে রাস্তা পার হয়। আর কোনো ছুতো পেলেই রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর করাটাকে মনে করে নাগরিক অধিকার। তাই এ দেশে কথিত লকডাউনের সময় অফিস খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধের হাস্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং তার প্রতিবাদে মানুষ যখন ভাঙচুর শুরু করে তখন সেই সিদ্ধান্ত বদলে বাধ্য হয়ে চালু করতে হয় গণপরিবহন। এমনকি দোকানপাট বন্ধের সিদ্ধান্তটাও বদলাতে হয় সরকারকে, আর মন্ত্রীর মুখে কঠোর লকডাউনের কথা শোনার পর সেই লকডাউন শুরুর আগেই মানুষ এমন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেনাকাটায়, যেন করোনাভাইরাস এক উৎসবের নাম!
আর এই স্বাধীন দেশের সরকার যারা চালান, তারা তো আর ভিনগ্রহ থেকে আসেননি; তারাও তো এ দেশেরই সন্তান। তাদের কাছ থেকেই বা অন্য রকম কিছু আশা করি কীভাবে?
দুই
‘লকডাউন’ ইংরেজি শব্দ হলেও করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর এই অভিধাটি জনপ্রিয় হয় প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ রুখে দেওয়ার চাইনিজ ফর্মুলা অনুসারে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পুরো উহান শহরকে ঘরবন্দি করে অল্প সময়ের মধ্যে এই মহাদুর্যোগ সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিল চাইনিজরা। এই ভাইরাসটি ল্যাবে ‘তৈরি’ করার জন্য চীনাদেরই দোষারোপ করছিল, এমনকি তারাও এরপর এই চীনা টোটকা অনুসরণ করতে শুরু করেছিল। গত বছরের মার্চ মাসের দিকে তো আসলে পুরো বিশ্বই থমকে গিয়েছিল এই লকডাউনের কবলে পড়ে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু জরা, মৃত্যু আর দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে থাকা বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুব সম্ভবত এটা সত্যিকারের সমাধান নয়। কারণ, মানুষকে ঘরবন্দি রাখতে হলে তাদের নিত্যদিনের প্রধান চাহিদা, খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। সেই ব্যবস্থা কী করে করা যাবে? একটা উদাহরণ হতে পারে ব্রিটিশ মডেল। ব্রিটেনে যখন মানুষকে ঘরবন্দি থাকার নির্দেশ দিচ্ছে সরকার, তখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতনের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। ঘরে বসে থাকলেও যেন ন্যূনতম খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে তারা। সেটা পাচ্ছে এমনকি রেস্টুরেন্টের কর্মীরাও; এ দেশে কি সেটা সম্ভব?
গত বছরের লকডাউনকালে তৈরি পোশাক খাতে প্রণোদনা আর প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে গরিব মানুষের কাছে টাকা পাঠানোর অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা যায় এ দেশের প্রেক্ষাপটে সেটা কতটা কঠিন। এ দেশের সরকারের কাছে পরিসংখ্যান এবং পরিকল্পনা এখনো যেন পরীর দেশের গল্প। আর অপ্রিয় হলেও সত্যি, নৈতিকতা শব্দটি সম্প্রতি একেবারেই অচেনা হয়ে উঠেছে। তাই সরকারের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই তৈরি পোশাক খাতে ঠিক কত শ্রমিক কাজ করে, কত মানুষের আপৎকালীন সহায়তা লাগতে পারে কিংবা, আসলেই কভিড পরিস্থিতি চূড়ান্ত খারাপ হলে কোন এলাকায় কী পরিমাণ হাসপাতাল বেড লাগতে পারে। তাই সরকার অবস্থা বুঝে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে, আর সেই সুযোগ নিচ্ছে নৈতিকতাহীন জনপ্রতিনিধি, তৈরি পোশাক কারখানার মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে পাড়ার ক্ষুদ্র দোকানি পর্যন্ত। নইলে, তিন টাকার সার্জিক্যাল মাস্ক গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে পনেরো টাকায় বিক্রি হতো কেন? এক টাকা দামের সিভিট ট্যাবলেটের দামইবা কেন পাঁচ থেকে দশ টাকা হয়ে উঠেছিল?
তিন
কভিড-১৯ পরিস্থিতি সামাল দিতে লকডাউন বিশ্বব্যাপী পরীক্ষিত একটি কৌশল। হ্যাঁ, এভাবে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু রোগ বিস্তারের গতিটাকে সাময়িকভাবে রুখে দেওয়া যায়, ফলে একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক রোগী সামাল দেওয়ার ঝক্কিটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে এই রোগের ভয়াবহতা এখনো টের পাওয়া যায়নি, আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষের যেহেতু তেমন কোনো লক্ষ্মণ নেই এবং হাসপাতালে যাওয়া ছাড়াই সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন, তাই গত এক বছরে বাংলাদেশের মানুষের করোনাভীতি উঠে গেছে বললে বোধ হয় খুব বেশি বলা হবে না। শারীরিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি মানা, বিশেষ করে মাস্ক পরার ব্যাপারে জনতার অনীহা থেকেই এই চালচিত্র বুঝে নেওয়া যায়। চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন ঘরে ঘরে করোনা রোগী, তখনো রাস্তায় বের হলে এ ব্যাপারে কাউকেই চিন্তিত বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে, এ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই এমন যে, এখানে ঘরে বসে থাকার সুযোগ খুব কম লোকেরই আছে। মাস শেষে নিশ্চিত বেতন পান যে সরকারি কর্মচারীরা, বেতনের টাকায় তাদের সংসারই চলে না। এ রকম চাকরিজীবীর সংখ্যাও কিন্তু নগণ্য, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ পরিবার হয়তো এই সুবিধা পান। বাকি যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী, তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ অনেক বেশি টাকা বেতন পান বটে; কিন্তু মালিকপক্ষ সুযোগ পেলেই তাদেরও ঠকায়। সাধারণ কর্মীদের কী অবস্থা, সেটা বলাই বাহুল্য। এদের বাইরে জনতার সবচেয়ে বড় যে অংশ খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা দোকানকর্মী, লকডাউন তাদের কাছে এক বিভীষিকার নাম। একেবারে শুরুতে তারা হয়তো মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু গত এক বছরে পুঁজি-পাট্টা হারিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এখন তাদের ভাবনা সরলরৈখিক, ‘করোনায় আর কজন মরছে, কাজ না থাকলে তো না খেয়েই মরতে হবে!’
এই প্রান্তিক মানুষদের লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো আর সেই সঙ্গে লকডাউনের সময় তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে ‘সাধারণ ছুটি’, ‘কঠোর বিধিনিষেধ’, ‘লকডাউন’, ‘সর্বাত্মক লকডাউন’, ‘আখেরি লকডাউন’ বা ‘আল্লার কসম লকডাউন’ যে নাম দিয়েই আয়োজন করা হোক না কেন, সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে, কল-কারখানা বা অফিস-আদালত ‘সীমিত পরিসরে’ খোলা রেখে ‘সর্বাত্মক বিধিনিষেধ’ যে আসলে শুভংকরের ফাঁকি, সেটা বুঝতে বাকি থাকবে না কারও।
লেখক সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sumanhaque@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.