আবদুল আজিজ:
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ। কক্সবাজারের রামু এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্যদের মত মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে যখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী। সে সময়ে কক্সবাজারে কোন ধরণের মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত না হলেও নতুন মুরুংপাড়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সংঘঠিত যুদ্ধে সর্বকনিষ্ট যুদ্ধা হিসাবে অংশ নিয়ে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ। তার সেই যুদ্ধের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন কক্সবাজার ভয়েসকে।
মুক্তিযুদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণে ‘যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে প্রস্তুত থাক’ এ কথায় সকল বাঙ্গালীর শরীরের শিরা-উপরিশরায় শিহরণ সৃষ্টি করে। উদ্ধেলিত করে বাঙ্গালী জাতিকে। একারণে আমরা দেখেছি কক্সবাজারে রামুর চৌমুহনীতে মরিচের গুড়া থেকে শুরু করে দা, চাকু ও লাটি নিয়ে চলে গেছে। ওই সময়ে একটি স্বশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষকে কিভাবে নাড়া দেয় একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন মন্ত্র আছে বলে মনে হয় না। সেসময়ে নিরস্ত্র জাতি স্বশস্ত্র জাতিতে পরিণত হয়েছিল।’
মোজাফ্ফ আহমদ বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রে যখন পাঞ্জাবিরা ঢাকার রাজারবাগ আক্রমণ থেকে শুরু সারাদেশে গণহত্যা শুরু করল, তখন কক্সবাজারে রামুর ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, মোজাম্মেল হক, প্রফেসর মোস্তাক আহমদ, শামশুল আলম চৌধুরী, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল হোসেনে চৌধুরী, ওবায়দুল হক থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতৃবৃন্দদের সমন্বয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। উক্ত সংগ্রাম কমিটি তখন জেলার বিভিন্ন থানা আক্রমণ করে অস্ত্র সংগ্রহ করে। পরে যখন পাকিস্তানীরা চট্টগ্রামের কালুঘাটে ছাত্রজনতার ব্যারিকেট ভেঙ্গে কক্সবাজারের দিকে আসতে দেখে অস্ত্রগুলো পুনরায় থানায় জমা দিয়ে সংগ্রাম কমিটির সকলে পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে চলে যায়। কিন্তু, আমরা ক্যাপ্টেন আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তি বাহিনী কক্সবাজারে রয়ে যায়।’
১৯৭১ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার (বার্মা) সরকার পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন উল্লেখ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ আরও বলেন, ‘ মিয়ানমার সরকারের মনে প্রচন্ড বিদ্বেষ ছিল। বাঙ্গালীরা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে যাচ্ছে তা তারা পছন্দ করত না। যারা পালিয়ে মিয়ানমারে চলে গিয়েছিল, তখন তাদের নানাভাবে হয়রানি ও ভীতির মধ্যে রাখা হয়েছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনী কাউকে কোথাও বের হতে দিত না এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে। তৎকালিন সময়ে বেঙ্গলী রিজিম্যান ইপিআরের কিছু লোক বার্মা গিয়ে একটি টিম কিছু অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রেরণ করে। পরে রামুতে নুরুল হক, আবু আহমেদ, রমেশ বড়–য়া, মমতাজুল হকসহ আমি ওই দলে যোগদান করি। তখন আমরা বিভিন্নভাবে আরও কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকি। এক পর্যায়ে আমাদের অস্ত্র বেড়ে যাওয়াতে আমরা মানুষ সংগ্রহে ব্যস্থ হয়ে পড়ি। ওই সময়ে সবচেয়ে বড় অপরেশন হয়েছে লামা থানায়। তখন নতুন মুরুংপাড়ায় একটি ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়। ওই ট্রেনিং সেন্টার থেকেই ডুলাজাহারা, ঈদগাহ, খুটাখালী সহ বিভিন্ন এলাকায় অংশ গ্রহন করে মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান জানিয়ে দেয়া হয়। তখন পাঞ্জাবিরা ভাল চোখে দেখে নাই। কক্সবাজারের শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা পাঞ্জাবিদের নিয়ে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে খুব সকালে আমাদের ট্রেনিং সেন্টার নতুন মুরুংপাড়া ঘেরাও করে। তখন আমরা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। ওই সময়ে পাঞ্জাবীদের সঙ্গে আমাদের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় ক্যাপ্টেন আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে। এক পর্যায়ে আমাদের পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দেয় পাক বাহিনী। তখন আমরা যে যার মত করে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহন করি। এসময় পাক বাহিনীর গুলিতে মারা যান লাপে লুং মুরুং নামের আমাদের সাথে থাকা এক সহযোদ্ধা। পরের দিন সকারে আমরা তার মৃতদেহ উদ্ধার করি। পরকর্তী পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে মিয়ানমারের পালিয়ে যাওয়া সেই সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দরা বাংলাদেশে এসে আমাদের ক্যাম্প হয়ে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যায়।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘তখনকার সময়ে কক্সবাজারে কোন যুদ্ধ না হওয়ার কারণ হচ্ছে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ পাকিস্তানী ছিলেন। সবাই পাকিস্তানীদের পক্ষ ছিল। তাদের কাছ থেকে আমরা কোন ধরণের সহযোগিতা পায়নি। যদি কক্সবাজারে এসব লোকেরা আমাদের সহযোগিতা করত, তাহলে মুক্তি বাহিনীতে পালিয়ে গহীন অরণ্যে থাকতে হত না। কিন্তু, দু:খের বিষয় ওই সময়ে যারা রাজাকার ছিলেন আজ তাদের অনেকেই এখন বড় মুক্তিযোদ্ধা।
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.