এন এন তরুণ:
লিখতে বসে কবি রফিক আজাদের কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি খুব মনে পড়ছে:
জানি, আপনার জুতা জোড়া, অতোটা চকচকে হবে না আমার হাতে
আপনার কাপড়গুলো অতোটা পরিষ্কার হবে না আমি কাঁচলে
তবুও
আমরাও তো চাই একটা কাজ, আমারও তো রয়েছে দায় পেটের পিঠের!
হুজুর মা-বাপ, এই শুয়োরের বাচ্চার জন্য কি একটা কাজ জোগাড় হবে না?’
সংকট যতই গভীর হোক, সমাধান অবশ্যই আছে। আর এর সমাধান হলো সম্মিলিত উদ্যোগ। কিন্তু সম্মিলিত উদ্যোগের আগে চাই সমন্বিত জীবনচেতনা, যা সমাজের গভীরে প্রথিত হওয়া দরকার। স্পিরিট অব কালেকটিভ লাইফ তথা সমন্বিত জীবনচেতনা হতে হবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন।
অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে যে কথাটি প্রথমেই আমার মনে আসে তা হলো, বাংলাদেশের যে উন্নয়নের কথা সর্বত্র আলোচিত, তা খুবই ভঙ্গুর—টেকশই উন্নয়ন থেকে যোজন যোজন দূরে। উন্নয়ন যদি টেকশই হয়, মহামারি সত্ত্বেও এত মানুষ রাতারাতি বেকার হবে না দুই কারণে: প্রথমত, শ্রমিকদের প্রতি কারখানার মালিকদের দায়বদ্ধতা থাকবে, তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন কাজের চাহিদা না থাকলেও বেতন দেওয়া অব্যাহত রাখতে। প্রয়োজনে তাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন, শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে হাত পাতবেন, কিন্তু তাঁরা কি শ্রমিকের দায়িত্ব থেকে সরে যাবেন না কিছুতেই।
বাংলাদেশে এটা ঘটছে না কারণ এ দেশে আজও একটি প্রকৃত শিল্পপতি শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। শিল্প খাতে যে শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তা মূলত লুটেরা যাঁরা ব্যাংকঋণ ইচ্ছে করেই পরিশোধ করেন না, ঋণের অর্থ দিয়ে বাড়ি-গাড়ি কেনেন, যথেচ্ছ বিদেশ ভ্রমণ করেন, বিলাসবহুল হোটেলে রাত কাটান, বিলাসী জীবন যাপন করেন। উল্লেখ্য, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ মোট ঋণ খেলাপির সংখ্যা ৮ হাজার ২৩৮ এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি।
দ্বিতীয়ত, টেকশই উন্নয়নে রাষ্ট্রের সক্ষমতা থাকতে হয় কারখানাগুলোকে পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেওয়ার এবং প্রণোদনার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার মতো সুশাসন। একই সঙ্গে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি কর্মীকে এমপ্লয়মেন্ট ইনস্যুরেন্স (নগদ অর্থ) প্রদান করার সক্ষমতা থাকতে হয় রাষ্ট্রের। উদাহরণস্বরূপ, কানাডা সরকার প্রচলিত ২৬ সপ্তাহের জায়গায় মহামারিতে চাকরি হারানোদের ৫০ সপ্তাহ পর্যন্ত এমপ্লয়মেন্ট ইনস্যুরেন্স প্রদান করার কথা ঘোষণা করেছে।
তৃতীয়ত, সমগ্র জনগোষ্ঠীর একটা ডেটাবেইস থাকা একান্ত জরুরি। এটা না থাকার কারণে আমরা জানতে পারছি না সরকারঘোষিত সাহায্য কতগুলো পরিবার পেয়েছে আর কতগুলো পরিবার পায়নি। একই কথা প্রযোজ্য কর্মীদের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ কারখানার মালিকদের জন্য সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তার কতটা শ্রমিকেরা পেয়েছেন, কী পরিমাণ পেয়েছেন অথবা আদৌ পেয়েছেন কি না। মোবাইলে অনলাইন ডেটাবেইসে ঢুকে নিজের নামের বিপরীতে তাঁর অর্থপ্রাপ্তির কথা নিজেই মাত্র কয়েকটি ঘরে টিক দিয়ে নিশ্চিত করবেন। সে ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ দায়েরও প্রয়োজন হবে না, কারণ তখন সবকিছুই সরকারের জ্ঞাত থাকবে।
কোভিড সৃষ্ট মহামারি ঠেকাতে যেসব সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষের দিকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও বেশি বরাদ্দ করেছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু তার সুফল সাধারণ মানুষ যা পেয়েছে, তা খুবই নগণ্য।
পোশাকশিল্পের কথাই যদি ধরি, আমরা দেখতে পাই যে রপ্তানিমুখী এ খাত সরকার, বিদেশি ক্রেতা ও দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ২০২০-এর ডিসেম্বর নাগাদ ৬২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৮৪ শতাংশই কারখানামালিকদের জন্য। আর বেতন-ভাতা বাবদ শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৬ শতাংশের মতো। কিন্তু এর মধ্যে কতজন শ্রমিক সরাসরি উপকার পেয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, গত বছর জুন পর্যন্ত দেশে ৪৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে। চলতি বছরে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। নিম্ন আয়ের ৩৫ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দরিদ্রের সংখ্যার তুলনায় এ সাহায্য খুবই অপ্রতুল। পুরোনো নতুন মিলিয়ে প্রায় ৭ কোটি দরিদ্র মানুষ এখন বাংলাদেশে। গড়ে ৪ জন করে একটি পরিবার হিসাব করলে ৩৫ লাখ নয়, ১৭৫ লাখ পরিবারের জন্য নগদ অর্থ সাহায্য দরকার। তবে দরিদ্র, হতদরিদ্র দুই ক্লাস্টারে ভাগ করে অর্থ সাহায্যে একটু ব্যবধান থাকতে পারে। আবার শহর আর গ্রামও দুই ক্লাস্টারে ভাগ করতে হবে। শহরের মানুষকে যেহেতু ভাড়া দিতে হয়, তাদের সাহায্যের পরিমাণও বেশি হওয়া দরকার। ক্লাস্টারের ব্যবধান মাথায় রেখে গড়ে ৫ হাজার টাকা করে সরকারের পক্ষে দেওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।
একটা কথা মনে রাখতে হবে যে এই অর্থ সাহায্য কমপক্ষে ৬ মাস চালিয়ে যেতে হবে। এটা আপৎকালীন অর্থনীতির ফর্মুলা। এটা মানতে হবে। না হলে সুফল পাওয়া যাবে না। অর্থনীতিতে মন্দা ঠেকাতে এগ্রিগেইট ডিমান্ড তথা সামষ্টিক চাহিদা বাড়াতে হবে, তার জন্য মানুষের ব্যয় করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে কিন্তু মানুষের হাতে তো অর্থ নেই। এ অবস্থায় সরকার কী করবে? সরকারকে মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছে দিতে হবে। গরিবের জন্য কিছু করার মানসিকতা যদি না-ও থাকে, সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থেই এটা করতে হবে।
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।
nntarun@gmail.com সূত্র:প্রথম আলো।
ভয়েস/জেইউ।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.