শাহীন হাসনাত:
পবিত্র রমজান মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে। এই মাসে ধর্মপ্রাণ মানুষ রোজা পালনের পাশাপাশি সাধারণ দান-খয়রাত, ওয়াজিব সদকাকতুল ফিতর ও ফরজ জাকাত আদায় করে থাকেন। এবার সর্বোচ্চ ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩১০ টাকা, সর্বনিম্ন ৭০ টাকা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হলেও সাধারণ মানুষজন সর্বনিম্ন অঙ্কটিই দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ বেশিও প্রদান করেন। এই সময়ে ৮ কোটি মানুষ গড়ে একশ টাকা করে ফিতরা দিলে ৮০০ কোটি টাকা। বাকি সাত কোটি মানুষ যদি এটা পায় সেটা ১০০ টাকার চেয়ে কিছু বেশি হতে পারে, যদিও এর বণ্টনে সমতা প্রত্যাশা করা যায় না।
রমজান মাসে মানুষ বাসাবাড়ি, মসজিদের সামনে, রাস্তায় কিংবা হাটবাজারে থাকা ভিক্ষুকদেরও একটু বেশিই দান করেন। এটা সাধারণ দান, যার হিসাব করা হয় না। পবিত্র রমজান মাসে প্রচুর ধর্মপ্রাণ মানুষ জাকাত দিয়ে থাকেন। ইসলামের পরিভাষায় ধনীদের ধনমালে আল্লাহর নির্ধারিত অবশ্য দেয় অংশকে জাকাত বলে। অর্থাৎ কারও কাছে বছর শেষে নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি থাকলে তার ওপর শতকরা আড়াই শতাংশ হারে জাকাত দিতে হয়।
জাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি। পবিত্র কোরআনের ৩০টি আয়াতে জাকাত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ আয়াতে নামাজের সঙ্গে সঙ্গে এবং দুই আয়াতে আলাদাভাবে। কোরআনে কারিমে বর্ণিত আছে, ‘ধনীদের সম্পদে রয়েছে প্রয়োজনশীল প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ সুরা আয যারিয়াত: ১৯
জাকাত একদিকে জাকাতদাতার ধনসম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। অন্যদিকে, দরিদ্রদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। জাকাত ফরজ হওয়ার পরও যদি কেউ তা প্রদান না করে, তার ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ইসলামের এই বিধান প্রত্যেক ধনী যদি যথাযথ অনুসরণ করেন, তাহলে এ দেশে জাকাতের বিশাল অর্থনীতি দাঁড়ায়। এতে করে বহু দরিদ্র মানুষ উপকৃত হতে পারেন। জাকাত ও সদকা বছরে একবারের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। উল্লেখযোগ্য ধনীরাও প্রায় সবাই মুসলমান। ধর্মের নিয়ম মেনে তাদের সম্পত্তির আড়াই শতাংশ জাকাত বছর শেষে দেওয়ার কথা। জাকাত ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা জানিয়েছে, অতি ধনী বিরাট একটা গোষ্ঠীর কাছে জাকাত দেওয়ার মতো আড়াই শত কোটি বা তার বেশি অর্থ রয়েছে। এই শ্রেণির কেউ কেউ বছরান্তে প্রায় সাত কোটি জাকাত প্রদান করেন। অতি ধনীর নিচের দিকে রয়েছে আরও কয়েক হাজার কোটিপতি। তারাসহ অন্য বিত্তবানরা নিয়ম অনুযায়ী জাকাত দিলে, সেই অংকটা নিঃসন্দেহে কয়েক লাখ কোটি টাকা হবে। এই টাকাগুলো সাত কোটি গরিবের মাঝে আবর্তিত হলে তাদের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন অনেকটাই কেটে যাবে। এর সঙ্গে যে অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে তা কভিডে সৃষ্ট দৈন্যদশা কাটিয়ে ওঠাকে সহজ করে তুলবে।
বোখারি শরিফের হাদিসে (২৬৪৬) বলা হয়েছে, ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই।’ দুঃখের বিষয় হলোÑমুসলমানরা তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করছে না। দেশের আর্থসামাজিক দুরবস্থা তার সাক্ষী। জাকাত প্রদানের নামে অনেক সময় কিছু ধনী আত্মপ্রদর্শনের আয়োজন করে। এভাবে জাকাত প্রদানে হতাহতের ঘটনা ঘটলেও আত্মপ্রদর্শনের লোভ ছাড়তে পারছে না তারা। অথচ সুরা নিসার ৩৮ নম্বর আয়াতে এমন দানকারী ‘আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী নয়’ বলে আল্লাহ নিজে জানাচ্ছেন। এর পরের আয়াতে তিনি আক্ষেপ করে বলছেন, তাদের কী হতো, তারা যদি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে দান করত? দানের ব্যাপারে আল্লাহ প্রকাশ্যে ও গোপনে দুইভাবে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ দান যদি প্রকাশ্যে হয় অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রদর্শনের ইচ্ছাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, গোপনে দানকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সুরা বাকারার ২৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এমন দানের ফলে পাপমোচন করা হয়।’
জাকাতের নামে মানুষকে কাপড়-চোপড় দেওয়া হয়। ঈদের আগে বিভিন্ন স্থানে জাকাতের কাপড়ের আলাদা দোকান গড়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও মার্কেটে জাকাতের জন্য আলাদাভাবে তৈরি শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া যায়। এসব কাপড় মানসম্পন্ন নয়, শুধুমাত্র গরিবদের দেওয়ার জন্য এগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে, দামও কম। অথচ দয়াময় আল্লাহ সুরা বাকারার ২৬৭ নম্বর আয়াতে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা দানের জন্য নিকৃষ্টটা খুঁজে বের কোরো না।’
সুরা আল ইমরানের ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কখনো পুণ্য অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না প্রিয় জিনিস দান করতে পারবে।’ জাকাতের নামে আমরা যা করছি সেটা মহান আল্লাহর দেওয়া প্রদত্ত নির্দেশনার সঙ্গে মেলে না। আমরা দান করে আবার ওই লোকদের সেবা গ্রহণ করি, অনেক সময় দানের বিনিময়ে লোকদের অধীনস্ত করে রাখি। অথচ সুরা বাকারার ২৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘দানের পর যারা অনুগ্রহের খোঁটা দেয় না এবং তাকে অন্য কোনো কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে পুরস্কার রয়েছে।’
সুরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে দানকে তুলনা করা হয়েছে শস্যদানার সঙ্গে। বলা হয়েছে, ‘একটি দান হচ্ছেÑ একটি শস্যদানা। সেখান থেকে বের হলো সাতটি শীষ। প্রত্যেকটি শীষে রয়েছে আবার ১০০টি করে দানা।’ তাহলে প্রত্যেকটি দান সাতশ গুণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে ব্যাপারটি এমন নয় যে, এক টাকা দান করে আমরা ৭০০ টাকা পেয়ে যাব, এমন পুরস্কার শুধু পরকালে বিশ্বাসীদের জন্য; সেটা প্রমাণিত হবে কেয়ামতের দিনে।
দানকে ঘিরে আমাদের যে মানসিকতা সেটা পরকাল বিশ্বাসের ঘাটতির কারণে তৈরি হচ্ছে। আমরা দানকে জাকাতের আড়াই শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। সেটাও আবার ঠিকভাবে মানি না। অথচ ইসলাম মনে করে, দানের প্রসঙ্গ মানুষের প্রয়োজনের নিরিখে যাচাই হবে। একজন মানুষ যখন অভাবগ্রস্ত হবে কিংবা বিপদে পড়বে তখনই দেওয়ার প্রশ্ন। চলতি করোনাকাল সম্ভবত দানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম যাচ্ছে। এই সময়ে ধনী ও সচ্ছলরা সঠিকভাবে দান-খয়রাত, সদকাতুল ফিতর ও জাকাত আদায় করলে দেশের সাত কোটি গরিব সহজে বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.