আবু আফজাল সালেহ:
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব প্রতিযোগিতায় ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। এখানে গবেষণা খুব কমই হয়। প্রকাশনাও অনেক কম। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এ দুটো ক্ষেত্রে যা হয় তার ‘কোয়ালিটি খুবই পুওর’। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাতের হার বেশি। যা আছে তার মধ্যে ভালো শিক্ষকের স্বল্পতাও রয়েছে। রাজনৈতিক বা বিভিন্ন কারণে ইনোভেশনের খুব কমই সুযোগ পাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে ক্রমেই। শিক্ষকদের একাংশের অনেক সময় ধরে পাঠদানে অনুপস্থিতও একটি কারণ। শিক্ষার মান অবনমনে শিক্ষকদের রাজনৈতিক গ্রুপিং করে বিভক্ত হওয়াও কম দায়ী নয়।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বর্তমান অনুপাতকে বেশ হতাশাজনকই। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে সর্বোচ্চ ৬২ জন শিক্ষার্থীকে পড়াতে হচ্ছে। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ৫-২০ জন শিক্ষার্থীও পড়াচ্ছেন। শিক্ষা ছুটি ও অন্যান্য কারণে অনুপস্থিত শিক্ষকদের গণনার বাইরে রাখা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আরও বাড়বে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হার অনুকূল রাখা সম্ভব হলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করে ইউজিসি। এ অবস্থার মধ্যেই দেশের উচ্চশিক্ষায় একটি ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে যে, বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিন হাজার শিক্ষকই আছেন শিক্ষাকার্যক্রমের বাইরে। ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)’ তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৫টি। ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক।
ছুটির কারণে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংকটে পড়ে। এসব ছুটি বা শিক্ষক অনুপস্থিতির কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে সেশনজট বাড়ছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, অনেক শিক্ষক নিজের পূর্ণকালীন চাকরির পাশাপাশি একাধিক খ-কালীন চাকরিতে নিয়োজিত। ফলে তারা যেমন নিজেরা ব্যক্তিগত অধ্যয়নে পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন না; তেমনি শিক্ষার্থীদেরও যথাযথভাবে শেখাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আছে। এরই মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষা ছুটিতে। প্রেষণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা, বিনা বেতনে ছুটিতে, ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান এবং খন্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে কিছু অংশ। অন্য প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন চাকরি করেন এমন বাস্তব পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবে অনেক ফাঁক আছে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খ-কালীন কাজ করছেন অনেকে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ছুটির বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগের বিধান আছে। কিন্তু অনেক সময় এ নিয়ম যথাযথভাবে চলে না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সেবাবঞ্চিত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের খ-কালীন বা পূর্ণকালীন চাকরি। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে রমরমা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। খন্ডকালীন শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায় ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের আপন করে নেওয়ার সময়ও পান না অনেকে। ফলে শিক্ষক অনুপস্থিতির প্রধান শিকার হন শিক্ষার্থীরা। ফলে, এ ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থা আসে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর বা অন্য খ-কালীন চাকরি ও গবেষণার সুযোগ প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ই রেখেছে। তবে এ ধরনের চাকরি করলে নিজ প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি আয়ের একটি অংশ সার্ভিস চার্জ বা ‘ওভার হেড চার্জ’ হিসেবে দিতে হবে শিক্ষককে। কিন্তু সেই অর্থ যাতে জমা দিতে না হয় সেজন্যই অনেক শিক্ষক নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতিটা পর্যন্ত নেন না। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাড়তি আয় থেকে। অন্যদিকে অনেক শিক্ষকের পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ আছে, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া শিক্ষকদের অনৈতিক কর্মকান্ড এবং অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কাজে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে থাকে বিভিন্ন গ্রুপ। ‘শিক্ষক রাজনীতি’ অনেকাংশে এই অনৈতিকতার জন্য দায়ী।
গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। দেশে মানসম্মত গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের অভাব। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষাকে সব সময় উৎসাহিত করা হয়। এজন্য সরকার বিশেষ বরাদ্দও দিয়ে থাকে। বিদেশে গমনকারী শিক্ষকরা বৈতনিক, অবৈতনিকসহ বিভিন্নভাবে সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত ছুটি নিতে পারেন। এ সময় কারও ডিগ্রি বা গবেষণা শেষ না হলে আরও দুবছরের অবৈতনিক ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু এজন্য এ ধরনের ছুটি ভোগের পর কেউ যদি পদত্যাগ করতে চান তাহলে তাকে চার বছর নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে হয়। বিকল্প পথ হচ্ছে, পদত্যাগকারী শিক্ষককে সমপরিমাণ সময় চাকরি করে তারপর অব্যাহতি নিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, যেহেতু নিয়মানুযায়ী শিক্ষকরা সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত শিক্ষাছুটি নিতে পারেন এবং এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বেতন-ভাতা সবই পরিশোধ করে, তাই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা আইনের এ ফাঁককে কাজে লাগিয়ে ছুটিতে গিয়ে অনেকে বাইরে আয়-উপার্জন করেন। বিদেশে ভালো অবস্থান পেলে অনেকে স্থায়ীভাবে সে দেশেই থেকে যান। এমন ঘটনা কম নয়।
বঙ্গবন্ধু ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জাতীয় শিক্ষা কমিশনের। তাদের রিপোর্টে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে সার্বিক বিশ্লেষণ ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ ছিল। বিভিন্ন সমস্যাও চিহ্নিত করেছিল এ কমিশন। শুরুতেই চিহ্নিত করেছিল ‘আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার বর্তমান পদ্ধতি নানা দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ’। উচ্চশিক্ষার অন্তত ছয়টি সূচকে উন্নতি না ঘটাতে পারলে তা পরিপূর্ণ ও কার্যকর হয় না। এই সূচকগুলো হচ্ছে দূরদৃষ্টি এবং কর্মপরিকল্পনা, প্রশাসন, শিক্ষা ও গবেষণা, গুণগত মান, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এসব সূচক অর্জনে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে খুব এগিয়ে তা কিন্তু নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা কাজ করে। কাগজে-কলমে দূরদৃষ্টি এবং কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলা হয়। বাস্তবে এগুলোর প্রতিফলন খুব কমই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন স¤পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ট্রাস্টি বোর্ড। উপাচার্যের স্থান ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের নিচে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো ক্ষমতা উপাচার্যের নেই। শিক্ষক-কর্মচারীরা মালিক কর্তৃপক্ষকে তোয়াজে ব্যস্ত থাকেন বেশির ভাগ সময়। কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত ভালো না মন্দ তা বলার শক্তি থাকে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এটা অবশ্য সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও ঘটে। তবে এ ক্ষেত্রে পক্ষ-বিপক্ষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যান শিক্ষকরা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো মানের কোনো গবেষণা হয় না। বরং আরও কম হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খ-কালীন শিক্ষকতায় নিয়োগ দিয়ে এরা ভালো শিক্ষকের অভাব পূরণের চেষ্টা করে। কিন্তু তেমন ফল পায় না। ‘ব্যবসা চলে যায় বলে’ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু বলেও না বা সরকারকে জানাতে আগ্রহ দেখায় না। পজিটিভ কর্মকর্তারা দেখে প্রথমে সমাধান করার চেষ্টাটা করেন। তবে বিভিন্ন বাধাবিপত্তির পর পিছিয়ে পড়েন। আমরা বাঙালি তো! ভালো মানুষের পেছনে ভালোই লাগতে পারি!
উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যের মধুর সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করতে হবে। শিক্ষকদের মর্যাদা-সংক্রান্ত বা অন্যান্য বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে পরিকল্পনা হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটা পাবলিক বা বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেখাশোনার জন্য সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’। এর ভিশন হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ও উদ্ভাবনী গবেষণায় উৎকর্ষ অর্জন, টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সার্বিক সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করা’। কিন্তু বাস্তবে ‘ইতিবাচক পরিবর্তন কতটুকু করতে পারছে’ তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ‘পজিটিভ পরিবর্তন’ আনতে হলে সরকারকে সরাসরিই এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
abuafzalsaleh@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.