পাভেল পার্থ:
মাতৃদুনিয়ার রক্তাক্ত জমিনে দাঁড়িয়ে আমরা পাড়ি দিচ্ছি এক দুঃসহ করোনাকাল। মহামারীর ক্ষত আর যন্ত্রণার দাগ আমাদের শরীর কি মনে এখনো দগদগে হয়ে আছে। এর ভেতর কিছুটা হলেও আমাদের উপলব্ধি হয়েছে মহামারী কি দুনিয়াব্যাপী সংকটের পেছনে মানুষের লাগামহীন বেপরোয়া জীবন আর করপোরেট অর্থনীতিই দায়ী। তীব্রভাবেই আমরা টের পাচ্ছি শীতকাল আর শীতকাল নেই, বর্ষায় নেই মেঘ, শরৎ কি হেমন্ত হয়েছে উধাও। আজ জলবায়ু সংকটে মুমূর্ষু বিশ্ব। প্রমাণিত হয়েছে কারা দায়ী আর কারা এর ভুক্তভোগী? জলবায়ু বিপর্যস্ত বিশ্বে আমাদের পাড়ি দিতে হচ্ছে এক নিদারুণ মহামারীকাল। আমরা বুঝতে পারছি সংকট সামালে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত রূপান্তর জরুরি। মহামারীর দুটি বছর পার করে আমরা তৃতীয় এক নতুন বছরে প্রবেশ করছি। নতুন এই বছরে আমরা কী আকাক্সক্ষা করতে পারি?
যদি আমরা মহামারী ও জলবায়ু সংকট সামাল দিতে চাই? নতুন বছরে আমরা কি ‘সবুজ-অর্থনীতির’ আকাক্সক্ষা করতে পারি? আমাদের অভ্যাস থেকে শুরু করে ঘরগেরস্থালি কী রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির খাত সর্বত্র? আমাদের কৃষাণীরা যখন বলেছিলেন বীজ আমাদের বংশরক্ষার হাতিয়ার, রাষ্ট্র তা কানে তোলেনি। গ্রামের শিশি-বোতল-ডুলি-কলস-রাও-হাঁড়ি সব শূন্য করে বীজসম্পদ তুলে দেওয়া হলো বহুজাতিক কোম্পানির জিম্মায়। হাজারো নামের ধান কি শস্যের বৈভব এক এক করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। বিল থেকে বাদাবনের গ্রামে ঢুকে পড়ল হাইব্রিডের মতো সংহারী বীজ। এসব বীজ চাষ করে দিনকে দিন কৃষকের সঙ্গে কোম্পানির সংঘর্ষ তৈরি হলো। গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়োরা চোখের জল বুকের দরদ ঢেলে হাত-পা জড়িয়ে বলেছিলেন, এই নদীটি আমাদের মেয়ে। নদীটিকে বাঁচান। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা কি ব্যবসায়ীরা তা শুনল না। নদীকে দূষিত ও দখল করে কারখানার পর কারখানা গড়ে তুলল। কলিজার সর্বশেষ রক্তবিন্দু ঢেলে আদিবাসীরা বলেছিলেন, জঙ্গলকে বাঁচাও, জঙ্গল না বাঁচলে আমরাও মরে যাব। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক কি অক্সিডেন্টাল-ইউনোকল ও শেভরনের মতো কোম্পানিরা তা শুনল না। শালবন উপড়ে রাবার বাগান তৈরি করল। প্রাকৃতিক বন কেটে আগ্রাসী গাছের বাণিজ্যিক বাগান তৈরি করা হলো। পাহাড় খুন করে তৈরি করা হলো সেনা ক্যাম্প, অরণ্য হত্যা করে বানানো হলো ফায়ারিং রেঞ্জ। তেল-গ্যাসের লোভে সুন্দরবনে ঢুকল শেল। লাউয়াছড়া বন ছিন্নভিন্ন করল ইউনোকল-শেভরন। মাটির তলার জল টেনে তুলে, বিষ আর সংহারী বীজ বাণিজ্যকে চাঙা রাখতে ‘খাদ্য নিরাপত্তার’ লোকদেখানো ছল তৈরি করে চালু হলো ‘সবুজ বিপ্লব’।
আমরা এমন এক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছি, যা কোনোভাবেই দেশের প্রাণ ও প্রকৃতির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। ২০০৭ সাল থেকে বিশ্ব ক্ষমতার ময়দানে বেশ কিছু তর্ক পাবলিক হয়ে ওঠে, নয়া উদারবাদী করপোরেট ব্যবস্থার টিকে থাকার শর্ত ও কারিগরি নিয়ে বাহাস ও দেনদরবার শুরু হয়। দক্ষিণ গোলার্ধের নিপীড়িত গ্রামের গরিব মানুষের পাশাপাশি প্রাণ ও প্রকৃতি-বিনাশী এই প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে জোট বাঁধতে শুরু করে শহরের প্রযুক্তিনির্ভর নানান পেশাজীবী মধ্যবিত্ত কি ধনীদেরও এক বিশাল অংশ। গাঁওগেরামের গরিব মানুষের প্রাণ ও প্রকৃতির দর্শন কিছুটা হলেও ‘সবুজ-অর্থনীতির’ তত্ত্ব-বাহাস নিয়ে হাজির হতে থাকে। অনেকে আবার এই তর্কও তুলছেন বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনের দীর্ঘ সময় পর উত্তরের ধনী দেশগুলো ‘সবুজ-অর্থনীতি’র ছুতোয় দক্ষিণের গরিব দেশের ওপর আবারও কোনো উপনিবেশ চাপিয়ে দিতে চাইছে। অবশ্যই এ বিষয়ে আমাদের পাবলিক সচেতনতা জরুরি। ‘সবুজ-অর্থনীতি’র মোড়কে আমরা আবারও প্রাণ ও জ্ঞানধারাকে পণ্যে পরিণত করতে চাই না।
আমরা ‘সবুজ-অর্থনীতি’ বলতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সবুজায়ন বুঝি, বুঝি চারধারের বাস্তুসংস্থানকে আগলে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক ধারাকে। আশা করি নতুন বছরে আমাদের মাটি-জল-হাওয়ার স্পর্শ-গন্ধে বিকশিত হয়ে উঠবে আমাদের ‘সবুজ-অর্থনীতি’।
একটি সমাজের সমন্বিত স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন, পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলা, প্রতিবেশগত ন্যায়বিচার সুরক্ষা ও বৈষম্যহীন সমতাকেন্দ্রিক রূপান্তরের ভেতর দিয়েই তার ‘সবুজ-অর্থনীতির’ রূপ ও কারিগরি সম্পর্কিত। প্রতিবেশ-আন্দোলন থেকে শুরু করে বিশ্বায়ন বিরোধিতা, নারীবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদ কি পরিবেশ-রাজনীতির মতো তত্ত্ব-তালাশ ও বৈশ্বিক বাহাসসমূহও সবুজ-অর্থনীতির অবয়ব নির্মাণে ভূমিকা রাখছে। আজ ডিসকোর্স হিসেবে সবুজ-অর্থনীতি এমন এক বয়ান তৈরি করছে, যেখানে বাজার থেকে শুরু করে উৎপাদন, উৎপাদন সম্পর্ক-উদ্বৃত্ত-মুনাফার রাজনীতি, প্রাণসম্পদের বিন্যাস ও বণ্টন, বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষা কি সমগ্র প্রাণভূগোলের যাপিতজীবনকে টেনে আনা জরুরি।
উত্তরের ধনী রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও ভোগ-বিলাসিতাই যে মাতৃদুনিয়াকে রক্তাক্ত করে তুলছে এ কথা আজ আর লুকোছাপার বিষয় নয়। দক্ষিণের নিপীড়িত জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়ে ‘সবুজ-অর্থনীতি’ উত্তরের এই অনিবার্য বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে জান দিয়ে হাজির না হলেও, কিছুটা ধাক্কা মারছে বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকেই। ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহে হাতেগোনা কিছু ‘সবুজ রাজনৈতিক দল’ কি জাতিসংঘের ‘সবুজ-অর্থনীতি’ আলোচনা হয়তো মাতৃদুনিয়ার বৈষম্যহীন বেঁচেবর্তে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়, কিন্তু একটি নয়া উদারবাদী করপোরেট দুনিয়ার বিরুদ্ধে এই আওয়াজগুলোকেও আজ গণ-আন্দোলনের সহায়ক হিসেবেই মাপা জরুরি।
আজ চলমান এই দুঃসহ করোনাকাল বারবার আমাদের এমন কোনো বৈশ্বিক রূপান্তরের ইশারাই দিয়ে যাচ্ছে। আজ রাজনৈতিকভাবে আমাদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরি, এমনকি পারিবারিকভাবেও প্রতিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক জীবনধারায় নিজেদের অভ্যস্ত করে তোলার চর্চা শুরু করা জরুরি। আর সেটি খাবার বা কোনো উপকরণ কেনা থেকে শুরু করে খাদ্যাভ্যাস, যানবাহন ব্যবহার, বৃক্ষায়নে ভূমিকা কি জীবাশ্ম জ্বালানি প্রশ্নে প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত অবস্থান ও অবদানকেও বৈশ্বিক আলাপে হাজির করা জরুরি।
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা পরিবেশগত ঝুঁকি ও করণীয় বিষয়সমূহ রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের ভেতর দিয়ে পরিবেশ সুরক্ষা সম্ভব নয়, একটি সত্যিকারের বৈষম্যহীন পরিবেশবান্ধব পৃথিবীর জন্য দরকার রাজনৈতিক বিপ্লব। সবুজ অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রযুক্তি ও প্রকৃতির সমন্বয়বাদী কার্ল বারকার্ট নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ স্থাপনা ও জ্বালানি, নিরাপদ যোগাযোগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি অধিকার ও ভূমি ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোকে উল্লেখ করেছেন।
সবুজ-অর্থনীতির বিশ্লেষকরা ‘সভ্যতার দশাসই উন্নয়নের’ সামনে গোলার্ধব্যাপী প্রাণ ও প্রকৃতির রক্তাক্ত শরীরকে টেনে এনে দেখাচ্ছেন, মাতৃদুনিয়ার এই করুণ পরিণতির জন্য প্রচলিত পুঁজিবাদী নয়া উদারনৈতিক ব্যবস্থাই দায়ী। এ ব্যবস্থা প্রশ্নহীনভাবে দুনিয়ার বুক-পিঠ ফালি ফালি করে কেটে ছিঁড়ে মুনাফা আর উদ্বৃত্ত লুণ্ঠনের ভেতর দিয়ে সভ্যতাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক মুমূর্ষু ক্রান্তিকালে। প্রাণ ও প্রকৃতির আপন বিবর্তন ও বিকাশমানতার পথকে রুদ্ধ করে রাখা এই নয়া উদারবাদী অধিপতি ক্ষমতার আমূল বদল চাইছে সবাই। সংজ্ঞায়নের দিক থেকে সবুজ-অর্থনীতি অনেকটাই বিমূর্ত হলেও সবুজ-অর্থনীতির অবস্থান সমাজের এই বৈষম্যহীন রূপান্তরের দিকেই।
‘প্রতিবেশ’ ধারণাটির উৎস খুঁজতে গিয়ে তাত্ত্বিক জন বেল্লামাই ফস্টার তার ‘মার্কস ইকোলজি : মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড নেচার (২০০০)’ শীর্ষক বইতে দেখিয়েছেন, বস্তুবাদী কার্ল মার্ক্স ও চার্লস ডারউইন তাদের তত্ত্ব ও চিন্তায় প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে প্রথম রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে সমন্বয় করেছেন। ভূমিকে কেন্দ্র করে সামন্ত ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিন্ন ধরন ও সংঘাতকে বিস্তারিত আলোচনা করে কার্ল মার্ক্স ভূ-সম্পত্তি বিস্তৃতির ভেতর পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী উত্থান আন্দাজ করেছিলেন। আমরা যদি সামাজিক শ্রেণিইতিহাসের নির্ঘণ্টে চোখ রাখি তবে দেখা যাবে ভূমি, জলধারা, অরণ্য কি প্রাণ ও প্রকৃতি সবকিছুকেই ন্যায়বিচার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সামন্তপ্রভু থেকে বুর্জোয়া মালিক, রাষ্ট্র থেকে করপোরেট এভাবেই আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতির মালিকানাস্বত্বের হাত ও ক্ষমতা বদল ঘটেছে। আর ক্ষমতার এই গণিত ও রদবদল পৃথিবীর জলবায়ুকে বারবার উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যস্ত এক মহামারীকালে তাহলে আমরা কি কেবল ক্ষমতার বলয়েই আটকে রাখব এক সবুজ পৃথিবীর টিকে থাকা ও থাকার সম্ভাবনাকে? আশা করি নতুন বছরে আমরা এসব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তরগুলো খোঁজার পাবলিক প্রচেষ্টা শুরু করব।
দেশের জনগণ ও প্রাণসম্পদের ওপর আস্থা ও দরদ রেখেই বাংলাদেশ সবুজ-অর্থনীতির এক বৈশ্বিক উদাহরণ তৈরি করতে পারে। এর জন্য জরুরি হবে রাষ্ট্রের পরিকল্পনা, নীতি, কর্মকৌশল ও বাজেটকে শরীর ও মনের দিক থেকে সবুজ করে তোলা। গ্রাম-বাংলার গরিব মানুষের উৎপাদন সম্পর্ক থেকে শুরু করে যাপিতজীবন সবকিছুই ‘সবুজ-অর্থনীতির’ অংশ। আমাদের গ্রাম-বাংলার মেহনতি নিম্নবর্গের জীবন শূন্য কার্বন পোড়ানো জীবন। যারা উৎপাদন, সংগ্রহ, ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে নির্মাণ কি শিল্পশৈলী সবকিছুকে ঘিরেই রচনা করে চলেছেন এক ‘সবুজ-অর্থনীতির’ ভিত। ভিতটাকে আরও মজবুত, আরও বিস্তৃত করতে দরকার সবার সাহসী উচ্চারণ, জানবাজি রাখা সম্মিলন। আশা করি নতুন বছরে আমরা সবুজ-অর্থনীতির সংগ্রামকে সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম হব।
লেখক গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
animistbangla@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.