মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
শিক্ষকতার সুবাদে প্রতিদিন নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় হয়। আবার মুফতি হিসেবে অনেকের নানা প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়। এসব প্রশ্নের সিংহভাগই পরিবারের অশান্তিকেন্দ্রিক। ঘটনাটি বেশ কয়েক বছর আগের। ক্লাসের সময় পিয়ন এসে বলল, প্রিন্সিপাল সাহেব সালাম দিয়েছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্লাস সংক্ষিপ্ত করে অফিস কক্ষে প্রবেশ করে দেখি প্রিন্সিপালের রুম নীরব-নিস্তব্ধ। সেখানে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। তিন সন্তানের বাবা তিনি। বড় ছেলে বিদেশ থাকেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে তার সঙ্গেই থাকেন। সে হিসেবে তাকে সুখী মানুষই মনে করতাম। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো একটু পর।
অফিসে বসার পরপরই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বয়স্ক মানুষের কান্না কীভাবে থামাতে হয়, তা জানা নেই। তাছাড়া তিনি কেন কাঁদছেন, সেটাও অজানা। তাই কিছুটা ভাবলেশহীন হয়ে বললাম, এভাবে কাঁদলে তো আমারও কান্না আসবে, কী হয়েছে সেটা বলুন। কোনো সমস্যা থাকলে সেটা সামাধান করার চেষ্টা করব। কিন্তু না, ভদ্রলোক কেঁদেই চলছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বলতে শুরু করলেন, জীবনের এ পর্যায়ে এসে আমি ক্লান্ত। আমার কষ্ট, দুঃখ, বেদনা বোঝার কেউ নেই। সবকিছু থাকার পরও আমি অসহায়। তার কথার মূল বিষয় হলো, কয়েকদিন আগে তার স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন। যে ছেলেটাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন, উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন, সে এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে দেশের বাইরে থাকে। মায়ের মৃত্যুর খবরে ব্যস্ততার অজুহাতে আসার সুযোগ পায়নি। বিষয়টি তিনি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। তাই তার এই কান্না।
এমন ঘটনা একটি দুটি নয়, রোজ ঘটছে। এমন ঘটনা নতুন শুনছেন, তাও নয়। কোনো বাবা হয়তো প্রকাশ করছেন, আবার অনেকেই নীরবে সয়ে যাচ্ছেন। বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে ধানমন্ডির মুহসিন খান নামের এক বয়স্ক লোকের প্রকাশ্যে আত্মহত্যার ঘটনায় নিঃসঙ্গ থাকা বাবাদের কষ্টের কথা আবার সামনে এলো। জীবনের পড়ন্ত বেলায় একা থাকা একটা মানুষের জন্য ভীষণ কষ্টের। আত্মহত্যার আগে বলে যাওয়া মুহসিন সাহেবের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি পরিবার-সমাজ-সংসারে নানাভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন। জীবন সংসারের ঘানি টেনেও তিনি একা। কেউ নেই পাশে। সব থেকেও, সবাই থেকেও তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। মুহসিন সাহেব আত্মহত্যা করে দেখিয়ে গেলেন, কত ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে আত্মীয়তার বন্ধন এগিয়ে যাচ্ছে!
বার্ধক্য মানবজীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। কোরআন মাজিদে খুবই সংক্ষেপে এর স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ -সুরা আর রুম : ৫৪
শৈশবেও মানুষ দুর্বল থাকে, বার্ধক্যেও দুর্বলতার দিকেই ফিরে আসে। বার্ধক্য মানেই নানাবিধ দুর্বলতা। এক বৃদ্ধ ব্যক্তি কী করুণভাবেই না দিয়েছেন বার্ধক্যের বিবরণ। ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার অবস্থা তো হচ্ছে, যা কালো থাকা আমার পছন্দের ছিল তা সাদা হয়ে গেছে, আর যা সাদা থাকা পছন্দের ছিল তা কালো হয়ে গেছে। যা শক্ত থাকা পছন্দের ছিল তা নরম হয়ে গেছে আর যা নরম-কোমল থাকা পছন্দের ছিল তা শক্ত-খসখসে হয়ে গেছে। পথ চলতে গেলে দেখি সঙ্গের লোকেরা আগে চলে যাচ্ছে, আর পেছনের লোকেরা আমাকে ধরে ফেলছে। নতুন কথা ভুলে যাই, পুরনো কথা মনে পড়ে। লোকের মাঝে ঝিমুই আর বিছানায় গেলে ঘুম আসে না। যখন দাঁড়াতে চাই জমিন আমাকে টেনে ধরে, যখন বসতে চাই ভূমি যেন দূরে চলে যায়!’
বার্ধক্যপীড়িত মানুষরা সমাজেরই অংশ। তারা আমাদেরই স্বজন, বাবা-মা কিংবা ভাই-বোন। এই সময়ে তাদের দরকার সহানুভূতি। এ জন্য প্রয়োজন গভীর মানবিক শিক্ষা। এই মানবিক বোধ ও চেতনার জন্য ইসলামি শিক্ষা ও আদর্শের দিকে ফিরে যেতে হবে। কোরআন-হাদিসের শিক্ষা একজন মানুষকে এই চেতনা দান করে, বার্ধক্য জীবনের একটি পর্ব, বেঁচে থাকলে যে পর্ব প্রত্যেকের জীবনেই আসছে। বার্ধক্যের দৃষ্টান্তগুলো তাকে বৃদ্ধের প্রতি অবহেলার নয়; বরং নিজের পরিণাম সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদিসে কী মর্মস্পর্শী ভাষায় বলেছেন, ‘সাত বিষয়ের আগেই আমল করে নাও। তোমাদের অবকাশ তো ওই দারিদ্র্য, যা আত্মবিস্মৃত করে, কিংবা ওই প্রাচুর্য, যা দাম্ভিক করে তোলে কিংবা ওই রোগ-ব্যাধি পর্যন্ত, যা জরাগ্রস্ত করে কিংবা ওই বার্ধক্য পর্যন্ত, যা বুদ্ধিহীন করে...।’ -জামে তিরমিজি : ২৩০৬
আগেই বলেছি, প্রবীণ বয়স মানবজীবনের এমন একটি অধ্যায়, যে পর্যায়ে এসে মানুষ প্রায় একা হয়ে পড়ে। এ সময় তার কমর্স্পৃহা হ্রাস পায় এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়। তাই প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিকটজনের মনোযোগ ও যতœ। কিন্তু বাংলাদেশের বতর্মান আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক বাস্তবতা ভিন্ন। তবে এটা বেশিদিনের চিত্র নয়। বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের দেশের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে তৈরি হচ্ছে একক পরিবার, এতে করে পরিবারগুলোতে প্রবীণরা ছিটকে অসহায় হয়ে পড়ছেন। তার পরও পরিবার ও সমাজ প্রবীণদের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী হবেন- এমনটাই প্রত্যাশা। কারণ, তারা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে সংসার গড়েছেন, সন্তানদের বড় করেছেন; তাদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা পরিবার ও সমাজে বোঝা নয়- ভরসা, ছায়া, পরামশর্দাতা ও অভিভাবক। তাদের প্রতি অবহেলা, উদাসীনতা, অমযার্দা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ইসলামে মা-বাবার সেবা ও সদাচারের যে তাকিদ রয়েছে, এই সেবা ও সদাচারকে যে অনন্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা কার না জানা আছে? মা-বাবার প্রতি উদাসীন হয়ে কেউ তো ভালো ইমানদার হতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের উফ্ বোলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতাবশে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ২৩-২৪
ইসলামে মা-বাবার সঙ্গে সদাচারের একটি দিক এটাও বলা হয়েছে, মা-বাবার বন্ধু-স্থানীয়দের সঙ্গে সদাচার ও সুসম্পর্ক রাখা। বলা বাহুল্য, এটা নবীন ও প্রবীণের মাঝে সুসম্পর্ক ও দেখা-সাক্ষাতের এক অতুলনীয় ব্যবস্থা। এটা বজায় থাকলে আজকের এই ক্ষয়ে যাওয়া সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা সৃষ্টি হতো না, কাউকে আত্মহত্যাও করতে হতো না। এক মুহসিন সাহেব আত্মহত্যা করেছেন, এ সমাজে আরও এমন হাজার হাজার মুহসিন সাহেব আছেন, তাদের বাঁচিয়ে রাখা, তাদের সেবা করা, তাদের যতœ নেওয়া আমাদের কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনে উদাসীন হলে দয়াময় আল্লাহর রোষানল থেকে কেউ বাঁচতে পারব না।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.