মো. মিকাইল আহমেদ:
আল্লাহতায়ালা কুরআনুল কারীমে মানবজাতির জন্যে ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন এবং সুদভিত্তিক সকল কার্যক্রমকে চিরতরে নিষিদ্ধ করেছেন। ইসলাম সর্বপ্রথম সুদের উচ্ছেদে যে মোক্ষম আঘাতটি হেনেছে তার মূল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে অর্থনীতিতে শোষণের অবসান ও যুলমতন্ত্রের বিলোপ সাধন। সুদকে সবচেয়ে পাপের জিনিস বলে গণ্য করা হয়েছে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় ও অর্থনীতিতে। যাবতীয অসৎ কাজের মধ্যে সুদ সবচেয়ে ভয়াবহ। সুদের করাল গ্রাস আজ ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সুদ একটি সমাজবিধ্বংসী অর্থনৈতিক হাতিয়ার। সুদের কুফলগুলোর প্রতি একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে কেন সুদ চিরতরে হারাম ঘোষিত হয়েছে।
কঠোরভাবে সুদ বর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পবিত্র কুরআনে। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা, আল্লাহকে ভয় করো এবং যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে সুদের মধ্যে যা বাকি আছে তা বর্জন করো। কিন্তু যদি তা না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। যদি তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, তাহলে তোমাদের জন্য তোমাদের মূলধন আছে। তোমরা অত্যাচার করবে না আর তোমরা অত্যাচারিত হবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৮)
সুদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।সুদের সাহায্যেই একদল লোক বিনাশ্রমে অন্যের কষ্টার্জিত উপার্জনে ভাগ বসায় ।সুদখোর লোকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহীতা যে কারণে টাকা ঋণ নেয় তাকে ঋণের টাকার উপর একটি নির্দিষ্ট হারে সুদের অর্থ দিতেই হবে যদিও সে কাজে ঋণগ্রহীতার কোন লাভ হোক বা না হোক। এর ফলে বহু সময়ে ঋণ গ্রহীতাকে সুদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে হয় স্থাপর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হলেও। সুদ গ্রহীতারা হচ্ছে সমাজের পরগাছা। বিনাশ্রমে এরা আয়েশি জীবন যাপন করে অন্যের উপার্জন ও সম্পদে ভাগ বসিয়ে ।
সুদের কারণেই একদিকে সমাজে ধনী শ্রেণী হয় আরও ধনী এবং অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণী হয় আরও দরিদ্র। সুদের ভয়াবহ পরিণামে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষ ঋণ নিতে বাধ্য হয় প্রয়োজনের সময়ে কোন উপায়ন্তর না দেখে, সাহায্যের কোন দরজা খোলা না পেয়ে। সেই সুদী ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে লোপ পায় ঋণ গ্রহীতার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা। বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় করযে হাসানার কোন সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনী খাতে ঋণ তো দূরের কথা বিনা সুদে ঋণ মেলে না উৎপাদনী খাতেও। ঋণ গ্রহীতাকে অনেক চড়া মূল্যে ঋণের সুদ শোধ করতে হয়। এর ফলে ঋণ গ্রহীতাকে তার শেষ সম্বল ভিটেমাটি টুকুও যা থাকে তাই বিক্রি করে উত্তমর্ণের ঋণ শোধ করতে হয় কখনো কখনো। সুদের এই বাড়তি অর্থ পেয়ে উত্তমর্ণ আরো ধনী হয়। আর এভাবেই সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সুদ মানুষকে কৃপণ ও স্বার্থপর করে। সুদখোরদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কার্পণ্য, অর্থলিপ্সা ও স্বার্থপরতা। সুদ প্রথার জন্ম হয়েছিলো বিনাশ্রমে উপার্জনের আকাংখা ও অর্থলিপ্সা হতে। সুদখোরদের আবেগ-অনুভূতি বিচার-বিবেচনা এমনকি বিবেককে পর্যন্ত নিঃসাড় করে দেয় সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয়প্রাপ্তির লোভ। সুদখোরদরে মধ্যে লোভ ও স্বার্থপরতা ক্রমেই বিস্তার লাভ করে। এর ফলে তাদের আচার-আচরণের বিশেষ পরিবর্তন ঘটে যে কারণে তারা হয়ে ওঠে সমাজের ঘৃণিত জীব।
সুদ অলসতা ও শ্রমবিমুখতা সৃষ্টি করে। সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোন পরিশ্রম ও ঝুঁকি ছাড়াই সুদের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে অর্থ পাওয়া যায় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে। ঝুঁকিহীন অর্থ উপার্জন এর এই ব্যবস্থা প্রতিভাবান, কর্মঠ ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোককে অলস ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপনকে ঘিরে একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা, নিরলস পরিশ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের মানসিক শক্তি ও কর্মস্পৃহা থাকে তা একজন সুদখোর ব্যক্তির মধ্যে কাজ করে না। বিনাশ্রমে অর্থলাভের সীমাহীন লোভ এসব প্রয়োজনীয় গুণাবলি নষ্ট করে দেয়। সুদভিত্তিক সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ হতে বিনাশ্রমে নির্ধারিত হারে আয় পেয়ে তারা পরিতৃপ্ত থাকে। অার আলস্য এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের গ্রাস করে ফেলে। তাদের মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও যোগ্যতার ফসল হতে সমাজের মানুষ বঞ্চিত হয়। সুদের কারণে যাদের হাতে অঢেল বিত্ত রয়েছে তাদের মধ্যে সৃষ্ট হয় শ্রমবিমুখতা ও অলসতা।
সামাজিক শোষণ সার্বিক ও সামষ্টিক, দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় সুদভিত্তিক বিনিয়োগের ফলেই। ছোট ছোট সঞ্চয় সমাবেশ ও সঞ্চালনের সুযোগে বিরাট পুঁজি গড়ে উঠছে সুদভিত্তিক ব্যাংক ও বীমা ব্যবসার কারণে। এই পুঁজি চড়া সুদে ঋণ দিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে বীমা ও ব্যাংক ব্যবসায়ে নিযুক্ত মুষ্টিমেয় ব্যক্তি । একই সাথে ঋণ দেবার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক শ্রেণী বৈষম্য ধনী ও দারিদ্রের বাছ-বিচারের কারণে । অর্থাৎ, শ্রেণী বৈষম্য আরও গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। শ্রেণী বৈষম্য হ্রাস না পেয়ে কেবল বাড়ছেই। উপরন্তু সুদী ব্যাংকগুলো ক্ষেত্রবিশেষে মুনাফার লেবাস পরিয়ে তাদের প্রদত্ত সুদকে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টাও করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে সরলমনা ধর্মভীরু মানুষ
প্রতারিত হচ্ছে।
আগের উম্মতের ওপর সুদের কারণে আজাবের কথা বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি ইহুদিদের জুলুমের কারণে তাদের জন্য যেসব পবিত্র বস্তু বৈধ ছিল, তা তাদের প্রতি অবৈধ করেছি এবং যেহেতু তারা অনেককে আল্লাহর পথ থেকে প্রতিরোধ করত এবং তারা সুদ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ করত...।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৬০)
চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ হারাম ঘোষণা করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা, তোমরা দ্বিগুণের ওপর দ্বিগুণ সুদ ভক্ষণ কোরো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যেন তোমরা সুফলপ্রাপ্ত হও। আর তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় করো, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩০)
সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে শোষণ অত্যন্ত কৌশলপূর্ণ। ব্যাংক আমানত বাবদ প্রাপ্ত অর্থের পুরোটা কখনই গচ্ছিত রাখে না। আমানতকারীরা যে অর্থ সঞ্চিত রাখে সাধারণতঃ ঐ অর্থের ৯০% ঋণ দিয়ে থাকে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের। বিনিয়োগকারীরা এই অর্থের জন্যে ব্যাংক কে যে সুদ দেয় তা আদায় করে নেয় জনগণের নিকট হতেই তাদের প্রদত্ত সেবা ও পণ্যসামগ্রীর মূল্যেই সঙ্গেই। ঐ সব আমানতকারীরাও রয়েছে এদের মধ্যে যারা ব্যাংকে অর্থ রেখেছে সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত নিরাপদ আয় করার উদ্দেশ্যে। ব্যাংক আদায়কৃত সুদ হতে একটা অংশ নিজস্ব ব্যয় নির্বাহের জন্যে রেখে বাকি অংশ আমানতকারীদের প্রাপ্য সুদ বাবদ তাদের হিসাবে জমা করে দেয়। এভাবেই ব্যাংক কৈ এর তেলে কৈ মাছ ভেজে নেয় আর অন্যদিকে প্রতারিত হয় আমানতকারীরা।
সুদ একটি অভিশাপ। এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই প্রযোজ্য। সুূদের কুপ্রভাব চিরকালই দরিদ্রের রক্তে পুঁজিবাদীদের রঞ্জিত করেছে। গরীবের রক্ত পানি করা টাকা দ্বারা পুঁজিবাদীদের আরাম-আয়েশের খোরাক জুগিয়েছে। এই অভিশপ্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, হজরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত, লানত অভিশাপ করেছেন, যে সুদ খায়, যে সুদ দেয়, যে সুদের দলিল লেখে এবং যে দুজন লোক সুদের সাক্ষী হয় তাদের প্রতি। অভিশাপ। রাসুলল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এটাও বলেছেন, গোনাহগার সাব্যস্ত হওয়ার দিক থেকে তারা সকলেই সমান। (মুসলিম শরিফ)
মহান আল্লাহ সুদের নিন্দা জানিয়ে কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যেসব সুদ প্রদান করো মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তা আল্লাহর কাছে বাড়বে না। আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে জাকাত আদায় করো তাদের দ্বিগুণ দেওয়া হবে।’ (সুরা রুম, আয়াত : ৩৯)
বর্তমানে সমাজের সর্বস্তরে সুদের যে বিস্তার লাভ করেছে এর ফলশ্রুতিতে সমাজে জেনা, ব্যভিচার, অন্যায়, অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে কয়েকগুণ। এক হাদিসে এসেছে হজরতে আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, সুদের গোনাহের ৭০টি অংশ রয়েছে। এর ক্ষুদ্রতম অংশ এই পরিমাণ যে, কোনো ব্যক্তি যেন স্বীয় মায়ের সঙ্গে সহবাস করে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ভয়াবহ সুূদের কালো থাবা হতে হেফাজত করুন।আমিন।
লেখক: মো. মিকাইল আহমেদ, শিক্ষার্থী: আইসিএমএবি, ঢাকা।
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.