মাছুম বিল্লাহ:
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা। ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। ২০০১ সালে চালু হওয়া গ্রেডিং পদ্ধতিতে এটিই জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২০২০ সালের অটো পাসকেও এটা হার মানিয়েছে। গতবারও এইচএসসিতে তার আগের বছরের তুলনায় ২৭ হাজার ৩৬২জন বেশি পরীক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছিল। ২০২১ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৯৫.২৬ শতাংশ। তবে ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীনে শুধু এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৯৫ দশমিক ৫৭। মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯৫.৪৯ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৯২.৮৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে এই পাসের হার ছিল ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২০ সালে ছিল পরীক্ষাহীন অটো পাস। অটো পাসের বছরে পাসের হার ছিল ১০০ শতাংশ। এই অটো পাস আসলে কোনো অর্থ বহন করছিল না। আর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও মানসিক তৃপ্তি বলতে কিছুই ছিল না।
ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৯৬.২০ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫৯ হাজার ২৯৯ জন। রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৯৭.২৯ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩২০০ হাজার ৮০০ জন। দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৯২.৪৩ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৩৪৯ জন। বরিশাল বোর্ড থেকে এবার ৬৮ হাজার ৪৪১ জন বেশি শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছিল কিন্তু পাস করেছে ৬৩ হাজার ৯৬৪ জন। ৯ হাজার ৯৭১ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। এ বছর এ বোর্ডে ৯৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বরিশাল বোর্ডে ৫ হাজার ৫৬৮ জন পরীক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। কুমিল্লা বোর্ডে ১৪ হাজার ১৫৩ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে। এ বছর বোর্ডের ৯৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর এ বোর্ডের ৯ হাজার ৩৬৪ জন পরীক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৯৪.৮০ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৭৩১ জন। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৮৯.৩৯ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৩ হাজার ৭২০ জন। ময়মনসিংহ বোর্ডে পাসের হার ৯৫.৭১ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭ হাজার ৬৮৭ জন। যশোর বোর্ডে পাসের হার ৯৮.১১ শতাংশ, জিপিএ ৫ পেয়েছে ২০ হাজার ৮৭৮ জন। রাজশাহীতে ৯৭.২৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮৯.৩৯ শতাংশ পাস করেছে।
২০২১ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ড মিলিয়ে মোট ১৪ লাখ ১৪৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষা শুরু হয় ২ ডিসেম্বর, শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর। এক মাসের মধ্যে ফল প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই হিসেবে জানুয়ারির শেষে কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফল প্রকাশের কথা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোর উত্তরপত্র আসতে দেরি হওয়ায় ফল তৈরিতে বিঘœ ঘটে। আমরা জানি, এবার সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি। শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি করে নৈর্বাচনিক বিষয়ে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়। তবে, অন্যান্য বিষয়ে এসএসসি ও জেএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ করে শিক্ষার্থীদের গ্রেড দেওয়া হয়েছে।
করোনা মহামারীর পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়ন ও অবিরত মূল্যায়ন বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। সামেটিভ মূল্যায়ন পদ্ধতি দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। আমাদের শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি পুরো শিক্ষাব্যবস্থা অবিরত মূল্যায়ন অর্থাৎ ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যাতে ‘যৌক্তিক পরীক্ষা’ নেওয়া হয় সে বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা বহুদিন যাবৎ বইয়ের সঙ্গে, প্রকৃত লেখাপড়ার সঙ্গে সেভাবে সংযুক্ত নেই। তাদের আমরা কোনোভাবেই সেজন্য দায়ী করতে পারি না। পরীক্ষা দিয়ে ফল অর্জন করার মধ্যে যে আনন্দ সেই আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছে কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেটি যাতে না হয় সেদিকে আমাদের সবার দৃষ্টি দিতে হবে।
গতবারের চেয়ে এবার ৩৩ হাজার ৯০১ জন পরীক্ষার্থী বেশি ছিল। গ্রুপভিত্তিক তিনটি বিষয়ে নম্বর ও সময় কমিয়ে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বহুনির্বাচনী ও সৃজনশীল অংশের পরীক্ষার মধ্যে কোনো বিরতি ছিল না। দেশের ১৯৩৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার শতভাগ তবে, ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করতে পারেনি। শতকরা পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের ৭৩৬টি, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের এক হাজার ৩টি ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ১৯৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ শিক্ষার্থী। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিম পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৮৭২ জন, আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৭৭৫ জন। পাসের হারের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে যশোর বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৯৮.১১ আর সবচেয়ে পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। জিপিএ ৫ প্রাপ্তির দিক দিয়ে সব বোর্ডের শীর্ষে আছে রাজশাহী বোর্ড, আর পিছিয়ে আছে সিলেট বোর্ড। কিন্তু পাসের হারে এক বোর্ড থেকে আরেক বোর্ডের এগিয়ে থাকা কিংবা পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কোনো বছরেই খতিয়ে দেখা হয় না। সব বোর্ডেই একই কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়, একইভাবে সব বোর্ডেই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকরা পড়ান, সবার কর্মঘণ্টা একই, সব বোর্ডেই গ্রাম ও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, কর্মদিবস একই তারপরেও কেন এত পার্থক্য? এই কারণ আমাদের খোঁজা উচিত, জানা উচিত, সবাইকে জানানো উচিত। প্রতিটি বোর্ডেই এজন্য একটি গবেষণা সেল থাকা একান্ত প্রয়োজন কিন্তু কেউই বোধ করছি বিষয়টি নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নন।
জিপিএ ৫ বৃদ্ধির তিনটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বাসায় বেশি বেশি প্রস্তুতি নিতে পেরেছে। আর এই সিলেবাস তাদের বেশ আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অনুসরণ করে একটি টপিক বা লেসনের ধারণা পাওয়া কষ্টকর। এটি এক ধরনের অসম্পূর্ণ লেখাপড়া, তারপরেও এটি করতে হয়েছে অবস্থা বিবেচনায়। জেএসসি ও এসএসসির ফল হিসেবে আবশ্যিক বিষয়ের নম্বর দেওয়া আর একটি কারণ। তৃতীয় কারণটি হচ্ছে ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষা না নিয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ে মূল্যায়ন। উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি অনেকটাই কঠিন, অনেক শিক্ষার্থী এখানে অকৃতকার্য হয়। এবার সেটি না থাকায় মূল্যায়ন অনেকটাই সহজতর হয়েছে। তাছাড়া খাতা দেখা হয় উদারভাবে। শিক্ষার্থীরা খাতায় কী লিখেছে তার চেয়ে কিছু লিখেছে কি না এই বিষয়টি দেখা হচ্ছে বহু বছর যাবৎ। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি বরং সহানুভূতি সহকারে নম্বর দেওয়া হয়েছে। তবে, ঢালাওভাবে জিপিএ ৫ পেলে একদিকে যেমন এ ধরনের মূল্যায়নের বিশ^াসযোগ্যতা হ্রাস পায় অন্যদিকে অনেক শিক্ষার্থীই ভালোমানের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেয়ে হতাশায় ভুগবে। এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক কষ্ট ও হতাশা বাড়াতে পারে।
লেখক : শিক্ষক ও শিক্ষাবিষয়ক গবেষক
masumbillah65@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.