তুষার আবদুল্লাহ:
প্রথম যখন ইতিহাস পাঠ করি, তখন ইতিহাসের আলাদা পাঠ্যবই ছিল না। সমাজবিজ্ঞান বইয়ের সঙ্গেই যুক্ত ছিল ইতিহাস। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আর্বিভূত হওয়ার যে আখ্যান পড়েছি, তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাইনি পরিবারে শোনা ইতিহাস।
বলতে হয় একাত্তরের কথাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি বর্ণনায় বইয়ের ভাষা, আর পরিবারের জ্যেষ্ঠদের কাছে শোনা বয়ানের মধ্যে বিস্তর তফাৎ ছিল। তফাতের চেয়ে বলা উচিত বিপরীত গল্প শুনেছি। বই আর শোনা ইতিহাসের মধ্যে ফারাক কেন? ফিস ফিস করে বলা হয়েছে, সময় এখন এমনই। এভাবেই লিখতে হবে এখন।
ছোট মানুষ, সময় খারাপ কী, কেন বুঝে উঠতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ বইয়ের বাইরে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানিয়েছেন আমাদের। আবার দুই একজন এমন শিক্ষকও আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বইয়ের চেয়ে একধাপ এগিয়ে গিয়ে বিকৃত গল্প শোনাতেন আমাদের। ধীরে ধীরে ক্লাস ডিঙিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারছিলাম সময়টা কেমন। কেন, বলা যাচ্ছে না সত্য গল্প।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ বইয়ের বাইরে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানিয়েছেন আমাদের। ধীরে ধীরে ক্লাস ডিঙিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারছিলাম সময়টা কেমন। কেন, বলা যাচ্ছে না সত্য গল্প।
বিদ্যায়তনে থাকতেই কাজে ঢুকে পড়ি। পেশাগত জীবনে এসে দেখি সহকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধকে দুই চোখে দেখছেন। শুধু দুই চোখে দেখাই না মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তারা বিভক্ত।
উচ্চশিক্ষার জায়গাতেও গিয়ে দেখলাম শিক্ষকরা আলাদা হয়ে আছেন, একাত্তর প্রশ্নে। আমি বিস্মিত হই না আর তখন। কারণ স্কুল থেকেই দেখে আসছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কীভাবে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া হচ্ছিল।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইতিহাস বদলে গেল ঠিকই, কিন্তু অপূর্ণতা রয়ে গেল। যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের কাছে গিয়েও ইতিহাসের সঠিক দরজার দেখা পাই না।
একাত্তরের বৃত্তান্তে সমগ্রের চেয়ে ব্যক্তির প্রাধান্য বড় হয়ে ওঠে। প্রত্যেকেই যেন একাত্তরের সেনাপতি বা সেক্টরের অধিকর্তা। নির্মোহভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলার সক্ষমতা তারা যেন অর্জন করতে পারেননি। এর একটা বড় কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বরাবর একেক রাজনৈতিক দলের চোখ দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারাও রাজনৈতিক আনুকূল্য পেতে, রাজনৈতিক দলের দর্পণে চোখ রেখেই ইতিহাসের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
একেবারে কেউ যে নির্মোহ কিংবা ব্যক্তিকে সরিয়ে ইতিহাস লেখা বা বর্ণনার চেষ্টা করেননি তা নয়, কিন্তু সেই বয়ান সমাজ, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি পায়নি অনেক ক্ষেত্রে। ফলে এই গোত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠরা স্বেচ্ছায় আড়ালে গিয়েছেন।
বিজয়ের ৫০ স্পর্শ করেও, কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস পেলাম না? এই প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের যেমন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ উত্তর প্রজন্মেরও।
নীতিগতভাবে গণমাধ্যমের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে দল দুটো বিভক্ত আছে স্পষ্টত। স্বাধীনতার বিপক্ষে যাদের অবস্থান বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করতে যারা অভ্যস্ত, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত বা নির্মোহ ইতিহাস প্রত্যাশা করার সুযোগ নেই। কিন্তু যাদের পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে। তারা যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস বলার ঢঙ বদলায়, তখন বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম।
বিজয়ের ৫০ স্পর্শ করেও, কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস পেলাম না? এই প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের যেমন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ উত্তর প্রজন্মেরও। অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন। ক্ষোভ ঝরে কারো কারো কণ্ঠে। কিন্তু আমি নিরাশ হইনি একবারেও। কারণ মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক বা বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, একাত্তরের পর বাংলাদেশের রাজনীতি সরল রেখায় চলেনি।
বারবার রাজনীতি তার গতিপথ হারিয়েছে বা পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে গিয়েও, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু কথা বলতে হয়েছে যেমন, তেমনি অনেক বিষয়ে নীরব থাকতে হয়েছে।
বলা যায়, ইতিহাস লেখার মতো নির্মোহ পরিবেশ খুব একটা আসেনি। আসলেও স্থায়ী হয়নি। এই বাস্তবতায় অপেক্ষা করতে হবে। নির্মোহভাবে পূর্বের বা বর্তমান প্রজন্ম যদি সঠিক ইতিহাস না লিখতে পারে, তবে আগামী প্রজন্ম ঠিক লিখে ফেলবে, একাত্তরের সত্য বয়ান। ইতিহাস কখনো বালির বাঁধে আটকে থাকবে না।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.