শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন:
পৃথিবীর কোনো সচেতন মানুষই যুদ্ধ সমর্থন করে না। বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর যে প্রান্তেই যুদ্ধ লাগুক না কেন ক্ষতিগ্রস্ত হয় সব প্রান্তের মানুষ। ভাবা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব থেকে যুদ্ধ দূর হবে। কিন্তু রাজনীতিবিদরা কখনো সামরিক ঝনঝনানি থামায়নি। কভিড মহামারীর সময়েও ইয়েমেনে, আফগানিস্তানে, ফিলিস্তিনে বোমা পড়েছে। এখনো মহামারী শেষ হয়নি। আফ্রিকা মহাদেশে মাত্র ১০ শতাংশের বেশি কিছু মানুষ করোনার টিকা পেয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্ব নেতারা হুমকি দিচ্ছেন পারমাণবিক যুদ্ধের।
রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির নতুন হিসাব-নিকাশ কষছেন বিশ্ব নেতারা। প্রশ্ন উঠেছে ইউক্রেন বলেই কি এই যুদ্ধের প্রতি বেশি নজর এসেছে। এই প্রশ্ন আরও বেশি বাতলে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টিভি চ্যানেল সিভিএস-এর জ্যেষ্ঠ বৈদেশিক প্রতিবেদক চার্লি ডি আগাটা। তার দাবি, ‘ইউক্রেন যুদ্ধকে ইরাক বা আফগানিস্তান যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কারণ ইউক্রেন অনেক সভ্য ও ইউরোপীয়।’ চার্লি ডি আগাটার এই বর্ণবাদী ও উপনিবেশিক মন্তব্য মূলত বিশ্বকে দেখার যে ইউরোপীয় হেজেমনি সেই উপনিবেশিক সময় থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রতিচ্ছবি।
আশ্চর্যের বিষয়, রাশিয়া দিনেদুপুরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ইউক্রেনের রাজধানীতে ঢুকে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে কিন্তু তবু বিশ্বের অনেক দেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। চাক্ষুষ আক্রমণ দেখেও বেশ কিছু দেশের নির্লিপ্ততা প্রমাণ করে বিশ্ব রাজনীতি থেকে আদর্শিকতার সময় শেষ হয়ে গেছে। সব যুদ্ধের সঙ্গে ভূ-রাজনীতি, সামরিক ব্যবসা ও লাভ-ক্ষতি জড়িত। ফলে সব রাষ্ট্রই তাদের নিজ নিজ লাভ-ক্ষতি ভেবে অবস্থান নিয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য মার্কিন ও ইউরোপীয়রা কম দায়ী নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হওয়া সবগুলো যুদ্ধে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে তাদের হাত ছিল। কখনো কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ও কখনো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে মুসলিম দেশগুলোর ওপর যুদ্ধ জারি রেখেছে পশ্চিমারা। পশ্চিমা স্যাটেলাইটের বাইরে গেলেই দেশগুলোর ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানের গুহা থেকে ৯/১১ হামলার অভিযোগ তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে দাবি করে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। গণতন্ত্র রপ্তানির নামে লিবিয়ার পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করেছে মার্কিন ও মার্কিনমিত্ররা। আবার গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতকারী মিসরের সামরিক শাসককে লালগালিচায় বরণ করে নিয়েছে। নিরীহ ফিলিস্তিনিরা যখন নিজের মাতৃভূমির রক্ষার লড়াইয়ে ইসরায়েলে অস্ত্রের মুখে পাথর ছুড়ছে তাদের বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী। আর ইসরায়েলি হামলাকে বলা হয় নিজেকে রক্ষার অধিকার। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে বিমান হামলা করছে সেই সময়েই সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলা, ইয়েমেনে সৌদি হামলা এবং সোমালিয়ায় মার্কিন বিমান হামলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব মিডিয়ার কোথাও এসব বিমান হামলা নিয়ে উদ্বেগ বা নিন্দা দেখা যায়নি।
ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও ইউরোপের নিরাপত্তা
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের সময়ের তুলনায় বর্তমান রাশিয়াকে ভøাদিমির পুতিন এখন সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে গেছেন। ফলে পুতিন এখন ১৯৯৭ সালের পর ন্যাটোর যে সম্প্রসারণ হয়েছে তা আটকাতে চান। পূর্ব ইউরোপ, মধ্য ইউরোপ ও বলকান অঞ্চলে ন্যাটোর উপস্থিতি বন্ধ করতে চান। পুতিনের দাবি ১৯৯০ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ‘ন্যাটো পূর্ব দিকে আর এক ইঞ্চিও এগোবে না’ বলে যে সমঝোতা হয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো সেটা অস্বীকার করে আসছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর ব্যাপকভাবে পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণ ঘটেছে। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ইউক্রেন, মলদোভা ও বেলারুশ ছাড়া বেশিরভাগ দেশই এখন ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিলেই ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি রাশিয়ার কাঁধে গিয়ে পৌঁছাত। সোভিয়েত পতনের পর ন্যাটোর প্রথম সম্প্রসারণ হয় ১৯৯৯ সালে হাঙ্গেরি ও চেক রিপাবলিককে সদস্য করার মধ্য দিয়ে। এরপর ন্যাটোর বড় সম্প্রসারণ হয় ২০০৪ সালে। ২০০৪ সালে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত তিন বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়াসহ ন্যাটোর সদস্য করা হয় বুলগেরিয়া, স্লোভানিয়া ও স্লোভাকিয়াকে। ২০০৯ সালে ক্রোয়েশিয়া, ২০১৭ সালে মন্টিনিগ্রো ও ২০২০ সালে উত্তর মেসিডোনিয়াকে ন্যাটোতে যুক্ত করা হয়। বলকান অঞ্চলের এই দেশগুলো সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার অংশ ছিল এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে এরা একেবারেই নবীন। এদের মধ্যে মন্টিনিগ্রো ও উত্তর মেসিডোনিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য না কিন্তু ন্যাটোভুক্ত হয়েছে।
ন্যাটোর এই সম্প্রসারণকে রাশিয়া নিজেদের নিরাপত্তা সংকট হিসেবে দেখছে। কিন্তু ইউক্রেনে হামলা হলেও ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। যদিওবা ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অর্থ, গোয়েন্দা তথ্যসহ নানা ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনকে। অবশ্য কার্যত বিনা বাধাতেই ইউক্রেন দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। বর্তমানে যুদ্ধ বন্ধ করে একটি কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে।
একটা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া রাশিয়ার জন্য যেমন সম্ভব নয় তেমনি ইউক্রেনে যুদ্ধে স্থায়ী হলে পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তা যেমন বিঘ্নিত হবে তেমনি শরণার্থীর ঢল বইতে হবে ইউরোপীয় দেশগুলোকে। ফলে যুদ্ধের একটি সমাধান হয়তো বের করার চেষ্টা করতে পারে দুই পক্ষই। ন্যাটো বাকি পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেক্ষেত্রে বেলারুশের মতো ইউক্রেন তাতে ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যখানে একটি ‘বাফার স্টেট’-এ পরিণত হতে পারে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার ওপর এখন যে সব অর্থনৈতিক, পরিবহন ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে যে রাশিয়ার ধারণা ছিল না বিষয়টি এমন নয়। রাশিয়া এখন ব্রিকস, সাংহাই করপোরেশনের মতো বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও বহুদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িত। ফলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন, ‘পশ্চিমা নিষেধজ্ঞায় রাশিয়ার কিছু যায় আসে না।’ রাশিয়ার অস্ত্র ও গ্যাস কেনার জন্য বহু দেশ মুখিয়ে আছে।
তবে এই যুদ্ধ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবাবে। ন্যাটো আদতে তাদের জন্য নিরাপত্তা তৈরি করতে পারছে কিনা সে প্রশ্ন আসবে। সদ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোকে ‘একটি ক্ষয়িষ্ণু জোট এবং সময়ের আবর্তে তা ভেঙে যাবে’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ফলে ২০২৪ সালে ফের রিপাবলিকরা ক্ষমতায় এলে সে ক্ষেত্রে ন্যাটো নিয়ে মার্কিন নীতি বদলাবে কিনা সে উদ্বেগ থাকছেই। এদিকে জার্মানির মতো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো ন্যাটোর জন্য সামরিক বাজেট কমাতে শুরু করেছে। ফলে পূর্ব ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া ভীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হবে। যা ‘নিরাপদ ইউরোপ’-এর যে ধারণা সেটাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.