আইরিন আকতার:
সফলতার সাথে এগিয়ে চলেছেন কক্সবাজারের নারী উদ্যোক্তারা। কক্সবাজার চেম্বার অব কর্মাসের তথ্য মতে কক্সবাজারে মোট ৫শত ৫০ জন নারী উদ্যোক্তা রয়েছে। তার মধ্যে ৪ ’ শ জনই অনলাইন ভিত্তিক। চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন “ আজ থেকে ৩ বছর আগে কক্সবাজারে এত নারী উদ্যোক্তা ছিলোনা। প্রযুক্তির আর্শীবাদে আমাদের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক নারী স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃস্টি করেছে। পুরুষের পাশাপাশি আর্থিক ভাবে সংসারের ভরন পোষনের দ্বায়িত্ব নিচ্ছে। যা কক্সবাজারের ই কর্মাসে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।”
৫৫০ জন নারী উদ্যোক্তার মধ্যে ৪০০ জনই অনলাইন ভিত্তিক
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ঘরে- বাইরে সমান ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে কক্সবাজারের নারী উদ্যোক্তারা। তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কেউ হচ্ছে শত নারীর পথ নির্দেশক, কেউ বা আবার শক্তভাবে টেনে ধরছে সংসারের হাল। কেউ নিজের পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে কেউবা আবার মানুষিক দুশ্চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য যুক্ত হচ্ছে অনলাইন ব্যবসার সাথে। নিজেদের মেধা আর শ্রমকে পুঁজি করে সফলতার সাথে এগিয়ে চলেছে কক্সবাজারের নারী উদ্যোক্তারা।
এমন পাঁচজন সফল উদ্যোক্তা নারী যারা হাজারো নারীর অনুপ্রেরণা।
নওশাভা মোক্তার সিয়াম
২২ বছর বয়সি এ নারী অনলাইনের মাধ্যমে ৮ শত নারীকে অনলাইন ব্যবসার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। উন্মোচিত করেছে কক্সবাজারে অনলাইন ব্যবসার দুয়ার। কক্সবাজারের মেয়ে হলেও চট্টগ্রামে পড়াশোনা করা কালীন উপলব্ধি করেন কক্সবাজারের নারীরা অনলাইন ব্যবসায় পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৯ সালে তখনও কক্সবাজারে খুব একটা অনলাইন উদ্যোক্তা ছিলোনা। তিনি “ডিভাস অব কক্সবাজার ” নামে একটি অনলাইন গ্রুপ চালু করেন। যার মাধ্যমে বর্তমানে ৮ শত ছোট বড় নারী উদ্যোক্তা কাজ করছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই সফল। অনেক অসহায় নারী স্বাবলম্বী হয়েছে, অনেকে সংসারের হাল ধরেছে আবার অনেকেই নিজের পরিচয় সৃষ্ট করেছে। ২০১৯ সালে মাত্র ৫ জন নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে তিনি অনলাইন মেলার আয়োজন করে। সেটিই ছিলো কক্সবাজারের প্রথন অনলাইন মেলা। এছাড়াও এ গ্রুপটির মাধ্যমে তারা অসহায় দিরদ্র নারী ও শিশুদের জন্য চিকিৎসা তহবিলের ব্যবস্থা করেছেন। ২০২০ সালে সিয়াম বাংলাদেশের সব থেকে বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম “ওমেন এন্ড ই-কমার্সে ট্রাস্ট থেকে বেস্ট লিডার পুরস্কার প্রাপ্ত হন। তিনি বলেন “চট্টগ্রামে পড়াশোনা করা কালীন কক্সবাজারের মেয়ে বলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই। তখন বুঝতে পারি আসলেই আমরা কক্সবাজারের মেয়েরা তথ্য প্রযুক্তির থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছি। ঢাকা, চট্টগ্রামের মেয়েরা অনলাইনের মাধ্যমে তখন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। চেয়েছিলাম অনলাইনের সাহায্যে কক্সবাজারের মেয়েরা ঘরে বসেই কিছু করতে। সেই ভাবনা থেকেই ডিভাস অব কক্সবাজার গ্রুপটি চালু করি। আজ সেখানে। প্রায় ২৩ হাজার নারী মেম্বার ও ৮ শতাধিক উদ্যোক্তা রয়েছে। এ গ্রপটিতে নারীরা ব্লক,বাটিক,হাতের কাজ,কসমেটিকস, গার্মেন্টস আইটেম,খাবার, ঘর সাজানোর পন্য, বিউটি পার্লার, সেলাইসহ বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন।
শাহরিন জাহান ইফতা
পৈত্রিক নিবাস ও পড়াশোনা চট্টগ্রাম হলেও বৈবাহিক সূত্রে কক্সবাজারের বাসিন্দা। ২০১৮ সালে সন্তান হারানোর শোক ভুলতে স্বামীর অনুপ্রেরণায় যুক্ত হন অনলাইন ব্যবসার সাথে। তিনি জানান “ রসনা বিলাস” এবং “ গ্লোরিয়াস ওমেন এন্টারপ্রাইজ অব বাংলাদেশ ” নামে দুটি গ্রুপ চালু করেন যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২২ হাজার। এবং ৪৮৯ জন উদ্যোক্তা। যার অধিকাংশই ছিলো গৃহিণী। এ দু' টি গ্রুপের মাধ্যমে নারীরা করছে বেচাকেনা। পরিচিত হচ্ছে নিজ পরিচয়ে। আবার অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই শুরু করছে অনলাইন ব্যবসা। এছাড়াও তিনি নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষে ব্যবস্থা করছেন ব্যবসা উন্নয়ন বিষয়ক কর্মশালার।
“ শাহরিন কুকিজ ও বেইক” ও “ রসনা বিলাস” নামে তার দুটি পেইজ যার মাধ্যমে তিনি রান্না করা বিভিন্ন খাবার ও মসলা ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। ঢাকা জয়েন স্টক থেকে বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের অধিনে তিনি “রসনা বিলাস” নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন।যার মাধ্যমে তিনি দরিদ্র ও অসহায় নরীদের সহায়তায় কাজ করছেন।
তিনি বলেন “ করোনা কালীন সময়ে যখন সব দোকান বন্ধ। মানুষ বাহিরে বের হতে পারছিলোনা। মানুষ কর্মহীন হয়ে পরছিলো। তখন কক্সবাজারের অনেক নারীই অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত হয়ে সংসারের হাল ধরেছে। জন্ম নিয়েছে অনেক অনলাইন ভিত্তিক নারী উদ্যোক্তা। তারা অধিকাংশই এখন সাবলম্বী। তাছাড়া করোনাকালীন সময়ে সকলেই অনলাইন নির্ভর হওয়াতে খুব ভালো সাড়া পেয়েছিলাম আমারা।”
রওনক আরা
রামু উত্তর মেরুংলোয়া থেকে ৩ বছর ধরে অনলাইনের মাধ্যমে কাজ করছেন কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী মোচা, নানা রকমের পিঠাপুলি এবং কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী নানা রকমের হোমমেড খাবার নিয়ে। কক্সবাজার ছাড়াও তার খাবারের স্বাদ আর সৌন্দর্য পৌছে যাচ্ছে চট্টগ্রাম,ঢাকাসহ,বিদেশেও। কক্সবাজারের ঐতিহ্যকে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছেন সারা দেশসহ বিদেশেও। পেশায় একজন হোমিও ডাক্তার হলেও তার অনলাইন ভিত্তিক রান্নার পেশাতেই পরিচিত হচ্ছেন কক্সবাজারবাসীর কাছে।
রওনক আরা কুক আর্ট নামে তার গ্রুমে ১১ হাজার সদস্য আছে। যার মধ্যে ৩৫০ জন অনলাইন ভিত্তিক নারী উদ্যোক্তা। তার অধীনে কাজ করছে পাঁচজন অসহায় নারী।
রসনাবিলাস গ্রুপ অব স্ট্রাট্রট বোর্ড এবং গ্লোরিয়াস ওমেন এন্টারপ্রাইজ অফ বাংলাদেশ থেকে বর্ষসেরা নারী উদ্যোক্তা, সেরা রাধুনি সহ বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে।
তিনি বলেন “উদ্যোক্তা জীবনের শুরুতে অনেক মানুষের কটু কথা আর হাসির খোরাক হতে হয়েছে। আজ আমি সফল। পরিবারকে আর্থিক ভাবে সার্পোট দেয়ার পাশাপাশি অন্য পাঁচ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ করেছি। আজকের এ সফলতার পেছনে অনেক শ্রম, ধৈর্য, সৃজনশীলতা, খাবারের মান, গ্রহকের চাহিদা আর বিশ্বাস যোগ্যতা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে।”
তিনি বলেন করোনান কালীন সময়ে যখন মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পরে। কেনাকাটা অনলাইন ভিত্তিক হয়ে পরে। তখন কক্সবাজারের ঐতিহ্য আর স্বাদের কথা মাথায় রেখে এবং অন্য উদ্যোক্তাদের থেকে অনুপ্রেরনা নিয়ে আমার মেয়েকে দিয়ে অনলাইনে একটি পেইজ খুলি। সেই থেকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আমার। যারা একবার অর্ডার করে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি। তারাই বার বার আমার কাছ থেকে খাবার অর্ডার করে। এখন এত বেশি অর্ডার আসে যে আমি পাশ ফেরারও সময় পাইনা।”
হেমা বড়ুয়া
কাজ করছেন নারীদের দেশীয় পোশাক ও ঘর সাজানোর বিভিন্ন পন্য নিয়ে। আজ থেকে বারো বছর আগে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন তার উদ্যোক্তা জীবন। মাত্র ৫ টি থ্রী- পিচ নিয়ে সাথে সাহস, ধৈর্য্য আর পরিশ্রম নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে মানুষের বাঁকা হাসি আর তুচ্ছতাচ্ছিল্যে দমে না গিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজের ব্যবসার প্রচার করেছিলেন। নিজের একটি পরিচয় দাড় করাতে থেমে যাননি।
তিনি বলেন “ ছোট বেলা থেকেই কস্ট করে মানুষ হয়েছি। আমি চেয়েছি নিজের পরিচয়ে বাঁচতে। শূন্য মূলধনে শুরু করেছি। আজ আমার মাসিন আয় লাখ টাকা। দাড় করিয়েছি নিজের নামে হেমা বুটিকস। আজ আমাকে অনেকেই চেনে। সম্মান করে। কিন্তু ১০ বছর আগেও তারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। আগে অফলাইনে কাজ করলেও অনলাইন আমাকে নতুন দুয়ারের সন্ধান দিয়েছে। গত ২ বছর আমি অনলাইনের বদৌলতে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পেরেছি।”
গ্লোরিয়াস ওমেন নামক অনলাইন গ্রুপ থেকে বর্ষসেরা নারী উদ্যোগতা পুরস্কার পান। তাছাড়া ৬২ হাজার মেম্বারের একটি গ্রুপ “সিওয়াইইসি” তে সাধারন সম্পাদক পদে মনোনীত হন তিনি। হেমা বুটিকস ও হেমা ড্রীম কর্নার নামে দু'টি পেইজ রয়েছে তার। যেখানে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ জয়েন আছে। তাছাড়া অফলাইনেও তিনি বেশ জনপ্রিয়।
জোবাইরা কবির চৌধুরী
কাজ করছেন কাস্টমাইজড থিম কেক নিয়ে। তার বানানো কেকের ডেকোরেশন ও স্বাদের কারনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন কক্সবাজারবাসীর কাছে। “লইয়ার্স বেক” নামে একটি অনলাইন পেইজের মাধ্যমে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন।
উখিয়া উপজেলার রত্নাপালাং ইউনিয়নের মেয়ে জোবাইরা কবির। চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইনান্স ও ব্যাংকিং নিয়ে মাস্টার্সে ৩.৩৯ সিজিপিএ নিয়ে ভাইস চ্যাস্নেলর গোল্ড মেডেল পাওয়া এ নারী শুধু গৃহিণী হয়েই তৃপ্ত ছিলেননা। পরিচিত হতে চেয়েছে নিজের পরিচয়ে। ছোটবেলা থেকে কেক বানানোর কোন অনুষ্ঠানই দেখতে বাদ দিতেন না তিনি। বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে দেখতেই যেন শেখা। ২০১৯ সাল থেকেই বিভিন্ন থিম দিয়ে কেক বানানোর কাজ কক্সবাজারে তিনিই প্রথম শুরু করেন। এবং অনলাইনে ব্যাপক ভাবে সাড়া ফেলেন। করোনা কালীন সময়ে তার কেকের চাহিদা আরো বেড়ে যায়। কেক বানানোর বিভিন্ন প্রতিযোগিতাতেও পুরস্কার প্রাপ্ত হন এ নারী। তিনি বলেন “ টিভির অনুষ্ঠানে ঢাকা ও বিদেশে বানানো বিভিন্ন থিম কেকগুলোর প্রতি আমার আকর্ষন ছিলো। কক্সবাজারের মানুষেরাও যেন নিজেদের পছন্দের থিমগুলো দিয়েই কেক নিতে পারেন। এটাই আমার চাওয়া ছিলো। সে আশা পূরন হয়েছে। এখন ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী থিম দিয়েই আমি কেক বানিয়ে তাদের দোর গোড়ায় পৌছে দিতে পারছি। এই কেক বানানোর কাজ অনেক সেনসিটিভ। একটু এদিক ওদিক হলেই পারফেক্ট হবে না। তাই আমি কোন সহকারি রাখিনা। গ্রাহককে চাহিদা শতভাগ পূরন করতে একাই পরিশ্রম করি। আর যারা একবার আমার কেক অর্ডার করেন তাদের কাছে বিশ্বাসের একটি জায়গা করতে পেরেছি। আমি নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ভাবে পরিবারকে সার্পোট দিতে পারছি।”
ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.