ড. রাহমান নাসির উদ্দিন:
আমাকে প্রায় একটি কথা শুনতে হয়, আমি কেন সংবাদপত্রে কলাম লিখি? কলাম লিখে আমি কেন সময় নষ্ট করি? এত সময় আমি পাই কোথায়? এসব কলাম তো সময়-নির্ধারিত বিষয় যার কারণে একটা বিশেষ সময়ের পরে এসব কলামের আর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্য থাকে না। তাহলে, কেন আমি এসব কলাম লিখে এত সময় ব্যয় করি? প্রশ্নটা খুবই ন্যায্য। চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন কিন্তু ক্রমবর্ধমান কাজের পরিধি এবং পরিসর আমাকে দু’দন্ড ফুরসত দেয় না। সেখানে কলাম লিখে সময় নষ্ট করার আদৌ কোনো মানে হয় কিনা, সেটা মৌলিক প্রশ্ন বটে। এখানে এ প্রশ্নের একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
একথা সত্য যে, সারা মাস এবং বছরজুড়ে নানান গবেষণা এবং অ্যাকাডেমিক লেখালেখির কাজে আমি ভীষণ ব্যস্ত থাকি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালের রিভিউয়ার হিসেবে কাজ করি। বিশ্বের নামি-দামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ম্যানুস্ক্রিপ্ট রিভিউ করি নিয়মিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী অ্যাকাডেমিক এবং প্রশাসনিক কাজের বাইরে গবেষণা তত্ত্বাবধানের কাজে প্রচুর সময় দিতে হয়। বিশ্বের বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান কমিটির বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করি। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কোলাবরেটিভ গবেষণার কাজ করি। নিয়মিতভাবে মাঠকর্মের কাজ করি। একটার পর একটা বই প্রকাশ করছি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে। নিয়মিতভাবে সম্পাদনার কাজ করি। এছাড়াও নানান ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতির অ্যাক্টিভিজমের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে নিয়মিতভাবে কিছু সময় ব্যয় করতে হয় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। টেলিভিশনের বিভিন্ন শো’তে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে কিছু সময় ভাগ করে নিতে হয় মিডিয়ার জন্য। এরকম নানান কিস্সা আছে! এরকম একটা ব্যস্ততার জীবনের যেখানে প্রতিটি মিনিট মূল্যবান, সেখানে কেন কলাম লিখে সময় নষ্ট করি! সুতরাং আমার কলাম লেখা নিয়ে শুভাকাক্সক্ষীদের এ সমালোচনা যথার্থ এবং মূল্যবান। কিন্তু আমার জবাবটা আরও অধিক মূল্যবান বলে আমি মনে করি।
সংবাদপত্রে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু, আন্তর্জাতিক নানান ঘটনাপ্রবাহ, খেলাধুলা, সাহিত্য, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়েই একটি সংবাদপত্রের কলেবর। কিন্তু তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব ধরনের সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয়, সেখানে পরের দিন প্রকাশিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ এবং কার্যকারিতা খানিকটা কমে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। এছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদপত্রের এখন অনলাইন ভার্সন আছে। অর্থাৎ আগামীকাল যেটা কাগজে ছাপা হবে, সেটা আজই অনলাইনে পড়ে নেওয়ার সুযোগ আছে। ফলে, সংবাদপত্রে সংবাদ পাঠের গুরুত্ব ততটা নেই বলেই, কলাম পড়ার পরিমাণ, পরিধি ও পরিসর ক্রমবর্ধমান। যদিও কলামের জনপ্রিয়তা নতুন কিছু নয়। অনেক পাঠক আছে, যারা সংবাদপত্রের কলামটাই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে পড়েন। সেটা অনলাইনে এবং ছাপার কাগজে দুই ভাবেই পড়েন। যেহেতু কলামে সংবাদের ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ থাকে, সেহেতু মানুষ সংবাদ পড়ার চেয়ে সংবাদের ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণে অধিক আগ্রহী। ফলে, কলামের জনপ্রিয়তা ছিল, আছে এবং থাকবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, পাঠক সংবাদপত্রের যেসব বিষয় অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে কলাম। কলামে প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদ বিশ্লেষণ, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ, বিভিন্ন ধরনের মতামত ও মুক্তচিন্তা। ফলে, কোনো একটা বিষয় নিয়ে বিজ্ঞজনেরা কী বলছেন, কী ভাবছেন এবং কোনো একটি বিষয়কে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কীভাবে দেখছেন, তার একটা চেহারা আমরা কলামের মধ্যে পাই। আর যারা নিয়মিতভাবে সংবাদপত্রে কলাম লেখেন তারা হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, বৃদ্ধিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মকর্তা, একজন অ্যাক্টিভিস্ট এবং পেশাদার কলাম লেখক প্রমুখ। কোনো একটা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যু একজন শিক্ষাবিদ কীভাবে দেখছেন, একজন সাংবাদিক কীভাবে বিশ্লেষণ করছেন, একজন রাজনৈতিক কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, কিংবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বা একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা কোন দৃষ্টিতে আলোচনা করছেন এবং একজন কবি-সাহিত্যিক কীভাবে দেখছেন বা একজন অ্যাক্টিভিস্ট কীভাবে উপস্থাপন করছেন, সেটা সংবাদপত্রের কলামে পাওয়া যায়। সে কারণেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন কলামের একটি বিপুল পাঠক শ্রেণি আছে। আর পাঠক শ্রেণি আছে বলেই এবং কলামের বিপুল পাঠকপ্রিয়তা আছে বলেই, বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদপত্র প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কলাম প্রকাশ করে। কলামের যে একটা বিপুল পাঠক শ্রেণি আছে, সেটা আমরা যারা নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে সংবাদপত্রে কলাম লিখি, তারাও টের পাই। কেননা, আমি নিজে দেখেছি কোনো সময় নানান ব্যস্ততার কারণে দুই সপ্তাহ কোনো কলাম লিখতে না-পারলে, ইনবক্সে পাঠক খোঁজ নেয় আমার কোনো সমস্যা হয়েছে কি না কিংবা সুস্থ আছি কি না। কিংবা কোনো একটা সেনসেশনার ইস্যু যখন সমাজে জারি থাকে, তখন ওই বিষয়ে আমার বক্তব্য কী সেটা জানতে চায় এবং ওই বিষয়ে আমাকে একটা কলাম লেখার অনুরোধ করেন। এতেই বোঝা যায়, পাঠক কলাম পড়েন এবং কলাম পড়ে নিজের বোঝাবুঝি ও চিন্তাভাবনাগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন কলামিস্টের চিন্তা-ভাবনা মিলিয়ে নিজের একটা অবস্থান ঠিক করেন। তাছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও অনেকের সঙ্গে দেখা হলে অনেক পাঠক বিভিন্ন কলামের রেফারেন্স দিয়ে বলেন, ‘আপনার ওই লেখাটা পড়েছি। ঐটা ভালো লেগেছে; কিন্তু আপনার ওই লেখাটার সঙ্গে আমি একমত নই’। এভাবে পাঠকের কাছ থেকে একটা রেসপন্স বা ফিডব্যাক পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায়, পাঠক কলাম পড়েন। ফলে, কলাম লেখার একটা নগদ লাভ হচ্ছে, নিজের চিন্তার এবং ভাবনার পাঠক তৈরি করা এবং নিজের চিন্তা-ভাবনা অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করার একটা প্যাসেজ তৈরি করা। তবে, আমি কেবল পাঠক তৈরি করা কিংবা একজন কলামনিস্ট হিসেবে সেলিব্রেটি ইমেইজ তৈরি করার জন্য সংবাদপত্রে কলাম লিখি না। এবং সে কারণেই আমি কখনো নিজেকে কলামনিস্ট হিসেবে পরিচয় দিই না এবং কলামনিস্ট কথাটা কোথাও লিখি না। তাহলে, কেন আমি সংবাদপত্রে কলাম লিখি?
আমি সংবাদপত্রে কলাম লিখি একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। একটা মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃদ্ধিক চর্চার অংশ হিসেবে। একটা অ্যাকাডেমিক কমিটমেন্ট থেকে। এবং একটা সচেতন অ্যাক্টিভিজমের অংশ হিসেবে। একথা আমরা সবাই জানি যে, সমাজ নিত্য পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তালে কিংবা বেতালে বোঝে কিংবা না-বোঝে সমাজে এক ধরনের রূপান্তর ঘটছে। কেননা পরিবর্তনশীলতাই সমাজের সহজাত প্রবণতা। ফলে, আমি চাই কিংবা না-চাই সমাজ তার নিজের নিয়মেই নিজের রূপান্তর ঘটাচ্ছে। আমার অবস্থান হচ্ছে, চোখের সামনে সমাজের এ পরিবর্তনকে কেবলই দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে না-দেখে পরিবর্তন প্রবণতাকে প্রভাবিত করার একটা বুদ্ধিবৃত্তিক চেষ্টাই হচ্ছে দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে আমার চিন্তা-ভাবনাগুলো সমাজের আর দশ জনের সঙ্গে শরিক করা। সমাজের পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা এবং পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রবণতাকে প্রভাবিত করা কিন্তু সমাজকে সচেতন করার একটা নৈতিক ও বুদ্ধিবৃদ্ধিক দায় থেকে আমি নিয়মিত বা অনিয়মিত ভাবে সংবাদপত্রে কলাম লিখি। বেশিরভাগ অ্যাকাডেমিক লেখালেখি সমাজের শিক্ষিত, অ্যাকাডেমিক ঘরানা এবং এলিট শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। বেশির ভাগ অ্যাকাডেমিক লেখা আমজনতার কিংবা সমাজে গড়পড়তা মানুষের কোনো কাজে আসে বলে আমার মনে হয় না। তাই, আমি সংবাদপত্রে নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে কলাম লিখি যাতে করে আমার চিন্তাভাবনাগুলো সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে শরিক করতে পারি। কতটুকু পারি কিংবা পারি না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু নিয়মিত বা অনিয়মিত কলাম লেখার মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিভাত করে যে, আমি সমাজের নিত্য রূপান্তরের কোনো নিষ্ক্রীয় দর্শক নই, বরং সক্রিয় অংশীদার।
লেখক নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.