সৌমিত্র দস্তিদার:
সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা/ সোনা নয় তত খাঁটি/ বলো যত খাঁটি, তার চেয়ে খাঁটি/ বাংলাদেশের মাটি রে আমার/ জন্মভূমির মাটি॥ আবদুল লতিফ
দুপুর দুপুর আজকাল কলকাতার রাস্তা হঠাৎ কেমন নদী হয়ে যায়। টালা ব্রিজের ওপর থেকে তাকালে মনে হয় এঁকেবেঁকে নদী যেন আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। মনের ভুল হয়তো, ঠিক একইভাবে গভীর রাতে চোখ বন্ধ করে আমি নদীর ডাক শুনতে পাই। ঘাট, নৌকার গলুই, মাঝি-মাল্লা, দরিয়ায় আইল তুফান, আয় কে যাবি আয়...।
কত কত নদী। দুধকুমার, লৌহজং, যমুনা, রূপসা, আড়িয়াল খাঁ, প্রিয় কীর্তনখোলা, মেঘনা আর পদ্মা। আরও কত জানা-অজানা নদী, জনপদ আমাকে হাতছানি দেয়। কখনো কোনো দিন সেভাবে যাকে চিনতাম না, সে কেন জানি না এখন পরম আদরে কাছে ডাকে।
কলকাতার রাস্তা কোনো এক জাদু-মন্ত্রে ঢাকা হয়ে যায়। ঢাকা, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বরিশাল আমি হাঁটতে থাকি। এভাবে চলতে চলতে আমিও যেন কীভাবে অকস্মাৎ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়ে যাই। চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে ঊনসত্তরের অনন্যসাধারণ ছাত্র আন্দোলন, যা আইয়ুব শাহীর স্বৈরশাসনকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল। আমি দেখতে থাকি ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের গভীর রুদ্র তেজ। মিলিটারির হিংস্র নখ দাঁতের মুখোমুখি হয়ে অসম সাহসে স্বাধীনতার মন্ত্র জপা। ২০ জানুয়ারি রাজপথে শহীদ হলেন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান। বিস্ফোরণ ঘটে গেল সারা পূর্ববাংলায়।
সারা জনপদ তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। কামার, কুমোর, জেলে, মাঝি, চাষি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, ছাত্র সমস্ত দেশের কোনায় কোনায় একসঙ্গে জেগে উঠেছে। ছাত্ররা আসন্ন বিপ্লবের বার্তাবহ। ছাত্রনেতাদের কেউ চলেছেন রংপুর, সিরাজগঞ্জ, কেউ ছুটছেন বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা বা সিলেট। এক একটা স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াচ্ছে। আলপথ দিয়ে ছুটে আসছেন জনতা। এ এক মহাকাব্যিক বিষয়। দিনের বেলা বসছে প্রকাশ্যে সভা। রাতে গোপন ডেরায় হ্যারিকেনের আলোয় রণকৌশল ঠিক করার মিটিং। নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধু স্বপ্ন দেখা। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলা। ভাষা আন্দোলনের আগে থেকেই যার শুরু, মওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনে যা গতি পায়, ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন তাকে বাস্তব করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।
তারপর ৭১ সাল। অগ্নিগর্ভ পূর্ববাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ। আর আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না। মহা মহা সব বর্ণময় চরিত্র শেখ সাহেব তো আছেনই। আর কে নেই সে তালিকায় মওলানা ভাসানী থেকে তাজউদ্দীন আহমদ।
২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। ঢাকার রাস্তা নদী হয়ে গেল রক্তের বন্যায়। পাল্টা প্রতিরোধ করতে দ্বিধা করেনি পূর্ববাংলার বীর জনতা।
আজ এত দিন বাদেও কতটুকু আর জানতে পেরেছি মুক্তিযুদ্ধের সত্যি ইতিহাস। ঢাকার সদরঘাটে গিয়ে আমি পথ চলতি লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজতে থাকি। যে রোগা, হাড় জিরজিরে বুড়ো কোচোয়ান সাবেক ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের সামনে বেতো ঘোড়ায় চাবুক মারছে, কে জানে সেও হয়তো অসম সাহসে রাইফেল তুলে নিয়েছিল দেশকে স্বাধীন করতে। কিংবা লঞ্চের যে সারেং বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে চুপচাপ বসে পরম নির্লিপ্তিতে বিড়ি খাচ্ছে সে কি দেখেছে যুদ্ধ! এই তো বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ। জীবনানন্দ দাশের বাসা। পাক-ফৌজ শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত হয়নি। অনেক বেশি সে মার খেয়েছে দেশের ভেতরের জনতার, গরিবস্য গরিব জনগণের হাতে। নদীতে, ক্ষেতে, গ্রামের আলপথে গেরিলাযুদ্ধের অনেক অকথিত কাহিনী আপনি চেষ্টা করলেই জানতে পারবেন।
ভিয়েতনামের লড়াই আমরা মনে রাখি। লাতিন আমেরিকার সংগ্রাম আমাদের শ্লাঘার বিষয়। অথচ ঘরের পাশের মুক্তির সংগ্রামকে আমরা সেভাবে মনে রাখিনি।
বরিশালের বানারীপাড়ার গাভা গ্রামের খুব কাছে ছোট একটা বধ্যভূমির কথা শুনছিলাম। যেমন ময়মনসিংহের এক গন্ড গ্রামে কীভাবে হিন্দু বাড়ি আগে আক্রান্ত হতে পারে আশঙ্কায় মুসলিম প্রতিবেশীরা নিজেরা সেখানে থেকে হিন্দু পড়শিদের নিরাপত্তার কারণে ভেতরের দিকে নিজেদের বাড়িতে শেল্টার দিয়েছিল। ঘটনাচক্রে আশঙ্কা সত্যি করে হানাদার বাহিনী সামনের দিকে হিন্দু থাকে ভেবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল নিরীহ মুসলমানদের। কোনো গ্রামে ভোর রাতে হিন্দু নারী-পুরুষ ভারতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, কী করে যেন খবর পেয়ে কয়েকশো মুসলিম পড়শি ঘিরে ধরে বলে ছিল, ফিরে চলো। মরলে একসঙ্গে মরব। বাঁচলেও একসঙ্গে। নিয়তির পরিহাসে আক্রমণ এলে মুসলিম জনতা তার হিন্দু বন্ধুকে বুক দিয়ে আগলে নিজেরা শহীদ হয়েছিলেন।
শুনছিলাম আর দেখছিলাম। মনে মনে দেখছিলাম জহির রায়হানের শট নেওয়ার টুকরো টুকরো নানা দৃশ্য। স্টপ জেনোসাইড শটের পর শট দেখতে পাচ্ছিলাম।
মনে পড়ে যাচ্ছিল আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনার কথা।
আমার দেশের সুখদেবের নাইনথ মান্থ টু গো। তারিক মাসুদের মুক্তির গান। লঞ্চ বরিশালের চরমোনাই পার হচ্ছে। দূরে বিপুল মসজিদের চূড়া। জলে অজানা এক পাখি গা ভেজাচ্ছে।
বাসের সিটে মাথা দিয়ে আনমনে বাংলাদেশের ভোর দেখছি। রাত ক্রমে ফিকে হচ্ছে। অদ্ভুত এক হলদে আলো ফুটছে আবছা হয়ে। আলো-অন্ধকারের এই বাংলাদেশকে আমি ভালোবাসি। আমি বাংলাদেশের কেউ না। সে অর্থে কোনো দিনই ছিলাম না। আমার পূর্ব পুরুষ দেশভাগের অনেক আগে বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তবুও ওই নদীমাতৃক দেশ আমাকে টানে। হতেই পারে। কোথায় কবে, কোন ভালোবাসা আর যুক্তি মেনে চলে!
স্থান-কাল-বাসস্থান সব কেমন ওলোট-পালট হয়ে যায়। সীমান্ত, কাঁটাতার অদৃশ্য হয়ে আমি শুধু শুনতে থাকি স্বাধীনতার গান। ছোটবেলা কোত্থেকে যেন ফিরে এসেছে। ১৬ ডিসেম্বর কনকনে ঠান্ডায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর কারা যেন কলকাতার রাস্তায় গান গাইছে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি... ফিসফিসিয়ে মা বলছেন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেছে। সেদিনের ছোট ছেলে আজ জীবনের অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছে। কিন্তু এখনো সে একা একা দুপুর রোদে বেকার হোস্টেলে যায়। সেখানে এক দিন থাকতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাছেই ইসলামিয়া কলেজ। এখন নাম বদলে মৌলানা আজাদ। গেট দিয়ে ঢুকে করিডরের পাশে এখনো ৪৬ সালের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এম রহমানের নাম জ্বলজ্বল করছে। বলাবাহুল্য এম রহমান আর কেউ নন। তিনি মুজিবুর রহমান। এ রকম দুপুরেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি কেন জানি না নদীর শব্দ শুনতে পাই। নদীর জলে ভাসতে ভাসতে আমি লড়াইয়ের গান শুনি।
লেখক ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.