সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী:
করোনার আগ্রাসী তৎপরতা কমে এলেও নানাবিধ অসুখের বিস্তার বাড়ছে, বাড়তেই থাকবে, যদি না পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পাল্টা ব্যবস্থা দুঃখ প্রকাশ ও নিন্দাজ্ঞাপন নয়; পাল্টা ব্যবস্থা পুকুরের পচা পানি বদলে ফেলা। দেশে এমন রেকর্ড-ভাঙা বন্যা ঘটেছে; এই প্লাবন তবু নামে, দূষিত পুকুরের পানি নামে না, সে আরও পচতে থাকে। তাকে বদলানোর ব্যবস্থা করা চাই। খুচরো অপরাধীদের শাস্তি চাই, কিন্তু মূল অপরাধীকে যেন না ভুলি, তাকে বদলে ফেলে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্বপালনকে যেন অবজ্ঞা না করি। নতুন ব্যবস্থাটা হবে সমাজতান্ত্রিক। তার মূল কথাটা ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরম দৌরাত্ম্য এখন বাংলাদেশে। এখানে কোনো মানুষই সন্তুষ্ট নয়। এমনকি বিত্তবানরাও নয়। তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, কিন্তু সে গাড়ির গতি নেই, রাস্তায় বের হলেই আটকা পড়তে হয়, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার মতোই; যেন শাস্তিপ্রাপ্ত আসামি। আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা শহর ইতিমধ্যে বিশ্বের নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। জরিপ বলছে বসবাসযোগ্যতার নিরিখে বর্তমান বিশ্বের ১৪০টি রাজধানী শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান একেবারে সর্বশেষে নয়, তবে খুবই কাছাকাছি। স্থান তার ১৩৭তম; সর্বনিম্নে রয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, যেখানে ভয়াবহ একটি যুদ্ধ চলেছে এবং চলছেও। ঢাকায় যুদ্ধ নেই, কিন্তু যুদ্ধাবস্থার বিড়ম্বনাগুলো সগৌরবে বিরাজ করছে। এর মধ্যেই উন্নতির গল্প শোনা যায়। শোনানো হয়। বলা হয় আয় বাড়ছে। অর্থনীতি চাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরার মধ্যেও অর্থনীতির যেটুকু উন্নতি তার রহস্যটা পুঁজিওয়ালাদের তৎপরতার জমা-খরচের খাতাতে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে মেহনতি মানুষের শ্রমের অলিখিত দিনলিপিতে। জরিপ বলছে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। উন্নতির সৌধ যখন মেহনতি মানুষের বুকের পাঁজরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবার ভরসা পায়, তখন সে শনৈঃ শনৈঃ উপরমুখো হবে না কেন?
মানুষ এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। মুক্তির জন্য সে লড়েছে। কিন্তু সে লড়াই সমাজের কাঠামোতে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি। সমাজকাঠামো রয়ে গেছে সেই আগের মতোই। রাষ্ট্রের আয়তন বিলক্ষণ ছোট হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরকার শোষণ-নিপীড়ন এক চুলও কমেনি, উল্টো বেড়েছে। বাড়তে পেরেছে, কারণ মুক্তির আন্দোলন সমাজতন্ত্রীরা করছে ঠিকই, বস্তুত তারাই ছিল চালিকাশক্তি, কিন্তু শাসনক্ষমতা রয়ে গেছে পুঁজিবাদীদের হাতেই। পুঁজিবাদে দীক্ষিত জাতীয়তাবাদীরা বেশে ও ছদ্মবেশে সামনে থেকেছে আন্দোলনের, এবং জনগণের আন্দোলনে-অর্জিত সুফল তারা মহানন্দে নিজের গোলায় তুলেছে। আত্মত্যাগ জনগণের, স্ফীতি পুঁজিবাদীদের। সব সুবিধা ধনীদেরই। বিশ্বজুড়ে এখন পুঁজিবাদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য। মানুষের সভ্যতা অপেক্ষায় আছে মৌলিক পরিবর্তনের। সে পরিবর্তন পুঁজিবাদের ভেতরে থেকে আসাটা একেবারেই সম্ভব নয়। নৈতিক জোর হারিয়ে পুঁজিবাদ এখন পৈশাচিক শক্তি দেখাচ্ছে। মুখোশ বদলাচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না, মুখটা তার অনেক অনেক বড়, মুখোশগুলোর তুলনায়। সে মুখ অত্যন্ত বীভৎস। রক্তরঞ্জিত। কত যে বীভৎস তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মিয়ানমারে। সেখানে গণহত্যা চলেছে। রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। চলেছে নারী ধর্ষণ, শিশুহত্যা। সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে; বলা হয়েছে জ্বালাও এবং মারো, গুলিতে না মরলে জবাই করো। অনুচ্চারিত অনুমোদন নয়, নির্দেশই রয়েছে ধর্ষণের। সংখ্যালঘু নিপীড়ন মানবাধিকার লঙ্ঘন নামে কুলাবে না, ঘটনা নির্লজ্জ ও নির্জলা গণহত্যা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই গণহত্যা যে পুরোপুরি বর্ণবাদী তাতেও কোনো সন্দেহ করার সুযোগ আগেও ছিল না, এখন তো একেবারেই নেই। মিয়ানমারের বর্মীরা ঐতিহাসিকভাবেই বর্ণবাদী। প্রমাণ আছে যে নিজেদের তারা শ্বেতাঙ্গ বলে ভাবতে পছন্দ করে, এবং ভারতীয়দের কৃষ্ণাঙ্গ মনে করে থাকে। ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা দখল করে, তখন থেকেই ভারতীয়রা বার্মায় গেছে, বিপুল সংখ্যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, শ্রমের বাজার সর্বত্রই তারা উপস্থিত ছিল। বাঙালিরাও গেছে। বাঙালিরা তো সবচেয়ে নিকট-প্রতিবেশী। বর্ণবাদের কারণে ভারতীয় বিতাড়ন তখন থেকেই সমানে চলেছে। ১৯৩০ ও ১৯৬০-এর দশকে তা ঘটেছে ব্যাপক হারে। কেবল যে রোহিঙ্গারা তা নয়, ভারতীয়রাও বিতাড়িত হয়েছে। বর্ণবাদী বার্মিজ শাসকরা এখন পুঁজিবাদী হয়েছে। তারা ঠিক করেছে মিয়ানমারে একজন রোহিঙ্গাও রাখবে না। যুগ যুগ ধরে যে রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করছে তাদের মেরে ধরে তাড়িয়ে সে জায়গায় নিজেরা বসে যাবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার আগেই কেড়ে নিয়েছিল, এখন শেকড়সহ উপড়ে ফেলবার মিশনে নেমেছে।
প্রচার করার চেষ্টা চলছে রোহিঙ্গারা দুষ্কৃতকারী। দুষ্কৃতকারী আমরাও ছিলাম। একাত্তরে। ওই নাম দিয়ে আমাদেরও নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। আমরাও ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম প্রতিবেশী ভারতে, রোহিঙ্গারা যেমন আশ্রয় খুঁজছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। এরা অনুপ্রবেশকারী নয়, শরণার্থী। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হচ্ছে তারা মুসলমান বলে নয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অমুসলিমও আছে; হত্যা করা হচ্ছে তারা দুর্বল জাতিসত্তার মানুষ বলে। অমুসলিম রোহিঙ্গারাও প্রাণ হারিয়েছে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। তাড়িয়ে দেওয়া হবে; তাদের জায়গা-জমি; ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িঘর সংখ্যাগরিষ্ঠরা দখল করে নেবে। রোহিঙ্গারা যাতে ফিরে না আসতে পারে তার জন্য মাইন পোঁতা হয়েছে সীমান্তে।
পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত ও গভীর। রোহিঙ্গাদের খালি করে দেওয়া জায়গাতে শিল্পএলাকা গড়ে তোলা হবে। সেখানে পুঁজিবিনিয়োগ ঘটবে। বিনিয়োগের জন্য ডাকা হচ্ছে চীন ও ভারতকে, বাংলাদেশের পুঁজিওয়ালারাও যেতে পারেন ইচ্ছা করলে। চীন আর এখন আগের চীন নেই। নেই যে তার প্রমাণ আমরা একাত্তরে কিছুটা পেয়েছি, এখন খুব ভালো ভাবে পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। পুঁজিবাদী-জাতীয়তাবাদী চীন এখন বিপুল হারে বিনিয়োগ করেছে মিয়ানমারে, আরও করবে আশা রাখে। রোহিঙ্গাদের বাঁচা-মরায় চীনের কিছু যায় আসে না। তার স্থির দৃষ্টি মুনাফার দিকে। রোহিঙ্গাদের আরেক প্রতিবেশী ভারত। ভারতের সঙ্গে চীনের এখন বেশ ভালো রকমের শত্রুতা, যুদ্ধ বাধে বাধে ভাব; কিন্তু ভারতও সমান আগ্রহী মিয়ানমারে বিনিয়োগের ব্যাপারে। রাশিয়াও অস্ত্র বিলি করে মিয়ানমারে। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনাতেও মিয়ানমারকে সে কাছে টানতে চায়। মিয়ানমারের গণহত্যায় তাদের বিরোধিতা নেই। শেয়ালরা সব এক হয়েছে, মাংসের গন্ধ পেয়ে।
সবচেয়ে বেশি বিপদ শিশুদেরই। শরণার্থী হয়ে যারা এসেছে তাদের শতকরা ৬০ জনই শিশু। এদের অনেকেরই পিতারা হারিয়ে গেছেন, মাতারা ধর্ষিত হয়েছেন, মারাও গেছেন। বহু শিশুরই অভিভাবক নেই। ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে। ছোট শিশুটি এসেছে বড় শিশুটির হাত ধরে। কিছুদিন আগে ভূমধ্যসাগরের কূলে একটি শরণার্থী কুর্দি শিশু বালুকাবেলায় পড়ে মারা গেছে; তার মর্মান্তিক ছবি সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তৈরি করেছিল। ওই রকমের ঘটনা কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তেও ঘটেছে। একটি শিশুর ছবি দেখেছি আমরা। মায়ের কোলে। জীবিত নয়, মৃত। ৪০ দিন বয়সের বস্ত্রহীন মৃত শিশুটি মায়ের কোলেই মারা গেছে। নৌকায় করে আসছিল। প্রায় তীরে এসে পৌঁছেছে, কয়েক গজ মাত্র বাকি, নৌকাটি তখন ডুবে যায়। শিশুটি মারা গেছে। মা যে কাঁদবেন তারও সময় নেই। আপনজন কেউ আসতে পেরেছেন কি না মা’কে সেটা খুঁজতে হচ্ছে। শরণার্থী অসংখ্য শিশু অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে, ছবিতে দেখেছি, আমরা। ক’জনের দিকে তাকাব? একটি ছাপিয়ে ওঠে অন্যদিকে।
প্রশ্ন থাকে, মিয়ানমারে কি মানুষ নেই? তারা দেখছেন না? হয়তো আছে; একাত্তরে যেমন পাকিস্তানে ছিল, কিন্তু স্বৈরশাসনের হাতে তাদের গলায় জোর নেই। মিয়ানমারে এক সময়ে ভয়াবহ সামরিক শাসন ছিল, সু চি ছিলেন তাদের শাসনে নির্যাতিত; পরে নির্বাচিত গণতন্ত্র এসেছিল, ক্ষমতা ছিল সু চি’র হাতে। রোহিঙ্গারা সামরিক শাসনেও নির্যাতিত হয়েছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে যেভাবে হয়েছিল, সেটা কল্পনাতীত। সুযোগ পেলে নির্বাচিত ‘গণতন্ত্রীরা’ও যে স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের ছাড়িয়ে যেতে পারে, সু চি সরকার তারই প্রমাণ। পুঁজিবাদী বিশ্বের সরকারগুলো সু চি’র পক্ষে থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। ঘটছে সেটাই। কিন্তু গণতন্ত্রীদের হটিয়ে আবার সেখানে সেনাশাসন পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে। সু চি হারিয়েছে ক্ষমতা।
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সব দেশে মানুষ এখন লড়ছে। এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদকে ভেঙে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে মানুষের পরিত্রাণ নেই; শিশুরা নিরাপত্তা পাবে না, দুর্বলের ক্রন্দন থামবে না, অন্ধকার ঘুচবে না; মানুষ উৎপাটিত হবে জন্মভূমি থেকে, পরিণত হবে ভিক্ষুকে; প্রকৃতি বিপন্ন হতেই থাকবে, এবং প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে মানুষের ওপর, যেমনটা নেওয়া ইতিমধ্যেই সে শুরু করেছে।
বাঁচার জন্যই পৃথিবীটাকে বদলানো চাই। লড়াইটা বাংলাদেশেও চলছে। কিন্তু তাকে তীব্র, সুসংগঠিত ও ক্রমাগ্রসরমান করা দরকার। এগুতে হবে, পরিত্রাণের লক্ষ্যে।
লেখক ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.