মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
দয়াময় আল্লাহতায়ালার অবারিত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে বিশ্ব মুমিন-মুসলমানের দ্বারে আবারও সমাগত সাম্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, মানবিকতা, ত্যাগ, সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস পবিত্র রমজান। রমজান মুসলমানদের জীবনে ক্ষমা লাভ ও পাপমুক্তির এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে। এই মাসের শবেকদরে নাজিল হয়েছে কোরআনে কারিম, এই কারণেও এই মাসের মর্যাদা ও তাৎপর্য অপরিসীম। রমজানের রোজা মানুষকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করায় ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষের কষ্ট, শিক্ষা দেয় মিতব্যয়িতার। মাসটি মানুষকে ভোগ নয়, ত্যাগের আদর্শে উদ্দীপ্ত করে। কিন্তু কৃত্রিম সংকটে সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যার কারণে রোজাদাররা কষ্ট পান, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকটাই নিয়মিত। এই সময় বাজারদরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়, ফলে খেয়ে না খেয়ে কিংবা আধপেট খেয়ে মানুষকে ফরজ ইবাদত রোজা পালন করতে হয়। অন্যদিকে লাভবান হয় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। পণ্য মজুদ, কৃত্রিম সংকট ও নানা অজুহাতে দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে তারা সাধারণ মানুষের পকেট কাটে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছরই রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কঠোর প্রতিশ্রুতি থাকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয় না। মানুষকে কষ্টেই দিন কাটাতে হয়।
অতীতের বাজার নিয়ন্ত্রণহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে রমজান এলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক বেড়ে যায়, মনে শঙ্কা জাগায় বরাবরের মতো এবারও সংযম ও ত্যাগের মাস রমজানে তাদের জন্য দুঃসহ যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। রোজার মাসে বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রতিটি সরকারের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া এ মাসে চাঁদাবাজরা তাদের তৎপরতা বাড়ায়, বিশেষ করে পরিবহন সেক্টরে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পরিবহন চাঁদাবাজির অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারেও প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে এবং নজরদারি বাড়াতে হবে। কেননা, ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরি মনোভাব এবং পরিবহন চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য কারণে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। আমাদের বিশ্বাস, এ কর্তব্য পালনে সরকারসহ দায়িত্বশীলরা সাধ্যমতো চেষ্টা করবে।
মনে রাখতে হবে, পবিত্র মাসে রোজাদাররা ভোগান্তির সম্মুখীন হলে তাদের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। সে কারণে রোজাদারদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে যারা ব্যবসার চক্রান্ত করছে তাদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। বাজার মনিটরিংয়ে হতে হবে আরও বেশি সক্রিয়। বিশেষ করে পেঁয়াজ, ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর ও ভোজ্য তেলের কৃত্রিম সংকট যাতে দানা বেঁধে না ওঠে সে ব্যাপারে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সাধারণ মানুষকে অযাচিত হয়রানি থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। বাজারে মনিটরিং বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান, অনিয়ম প্রমাণিত হলে বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, নিত্যপণ্যের সরকারি মজুদ বাড়িয়ে তা ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ, মনিটরিং ব্যবস্থাপনায় কোনো অবহেলা বা দুর্নীতি হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা, এক বাক্যে বলতে গেলে কঠোর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সরকারের মনিটরিং কমিটির মধ্যে আন্তরিকতা, দক্ষতা ও সততা থাকলে অবশ্যই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এটা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এর মাধ্যমে রোজাদারের প্রতি এক ধরনের সহমর্মিতা প্রকাশ পায়।
রোজা পরস্পরে সাহায্য-সহযোগিতা, সমবেদনা তথা সহমর্মিতা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে যথাযথভাবে অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন করলে, কাজটি সহজ হয়। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের ফাঁকি, অলসতা, অসততা কাম্য নয়। ইসলামের শিক্ষা, কোনো মানুষ কাউকে অকারণে কষ্ট দেবে না। আর প্রকৃত রোজাদারের কাছ থেকে তো কোনো অবস্থাতেই প্রতারণামূলক ব্যবহার ও আচরণ প্রত্যাশা করা হয় না। সত্যিকারের রোজাদার কারও অনিষ্ট, অকল্যাণ ও ক্ষতিসাধন করে না; বরং মাহে রমজানে সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র, দুর্বল, পীড়িত, অসুস্থ, অনাথ, ছিন্নমূল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত নিরন্ন মানুষের খোঁজখবর রাখবেন, তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করবেন, সাহরি-ইফতারের আয়োজন করবেন, যথাসম্ভব সাধ্য অনুযায়ী পরোপকারে ব্যস্ত থাকবেন। ধনী-গরিব আপামর রোজাদার এভাবে রোজার মাসে সহমর্মিতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার অনুশীলনের মাধ্যমে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হন। প্রকৃত রোজাদার ও ধর্মপ্রাণরা সব সময়ই অসৎ কাজকর্ম থেকে দূরে থেকে বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের প্রতি পারস্পরিক সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
সমাজে মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় রমজানের রোজার যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। প্রত্যেক মানুষের যে সম-অধিকার রয়েছে, প্রকৃত রোজাদার তা উপলব্ধি করতে পারেন এবং সমাজের গরিব মানুষের প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেন। কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অসদাচরণ, অন্যায়-আচরণ ও অপরাধমূলক কাজ করেন না। রোজাদাররা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সাম্যের জয়ধ্বনি করেন। সমাজের শ্রমজীবী খেটে খাওয়া সম্বলহারা মানুষ যাতে রমজানের রোজা যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য ধনী-সামর্থ্যবান রোজাদারেরা দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন। মালিকেরা শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, অগ্রিম বেতন-ভাতা প্রদান ও কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেন। এভাবে মাহে রমজানের দিনে অধীনস্ত শ্রমিক, কর্মচারী এবং চাকর-বাকরদের দায়িত্ব ও কাজকর্ম হালকা করে দেওয়া উচিত। এ মাসে তাদের ওপর কষ্টকর সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপানো সম্পূর্ণ অনুচিত, এটা অমানবিকও বটে। কারণ তারাও রোজাদার, রোজা রেখে তারা অধিক কষ্টসাধ্য কাজ করলে বেশি ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে। তাই কঠিন ও সাধ্যাতীত কাজের বোঝা চাপিয়ে যাতে তাদের অধিক কষ্ট দেওয়া না হয়, সেদিকটি অবশ্যই মানবিক বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমনভাবে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এ মাসে (রমজানে) যারা দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেন, অর্থাৎ তাদের কাজের বোঝা হালকা করেন আল্লাহ তাদের দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন।’
মাহে রমজানে সমাজের স্থিতিশীলতা, শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষ যদি রমজানের মতো অন্যান্য মাসেও আত্মসংযমের সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দল-মতনির্বিশেষে সব ধরনের বিরোধ এড়িয়ে যান, তাহলে কোনো রকম সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। তাই সমাজজীবনে পরস্পরের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এবং সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাসব্যাপী রোজাদার ধনী লোকেরা গরিবের দুঃখ-কষ্ট এবং অনাহারের জ্বালা মর্মে মর্মে অনুভব করে স্বভাবতই সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র ও দুস্থদের প্রতি অত্যন্ত সদয় আচরণ করেন। এ ছাড়া, সারা বছরই হতদরিদ্র ও আর্তমানবতার প্রতি সমবেদনা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ মাহে রমজানের মহান শিক্ষা।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.