সৈয়দা শারমিন আক্তার:
শরীরের ধরন অনুযায়ী একেক জনের খাদ্যাভ্যাস একেক রকম। শুধু পানি খেয়ে রোজা যেমন ক্ষতিকর তেমনি অতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়াও ঠিক নয়। খাবার নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে যাতে ওজন খুব বেড়ে বা কমে না যায়। রোজার সময় খাবার নির্বাচন নিয়ে জানালেন ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার
এমন খাবার খেতে হবে, যা হজম হতে বেশি সময় লাগে। অর্থাৎ যেসব খাবার হজম হতে প্রায় আট ঘণ্টার মতো সময় লাগে। এ রকম খাবার হলো লাল চাল, লাল আটা, ওটস, বার্লি, নানা ধরনের ডাল ও শিমের বিচি।
যেসব খাবারে খাদ্যআঁশ বেশি থাকে, সেসব খাবার হজম হতে বেশি সময় লাগে। শস্যজাতীয় খাবার ছাড়াও শাকসবজি, খোসাসহ ফল, শুকনা ফল, বাদাম ইত্যাদি খাদ্যআঁশসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
অধিক ভাজাপোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এ ধরনের খাবারে বদহজম, বুক জ্বালাপোড়াসহ ওজন বৃদ্ধিজনিত নানা সমস্যার জন্য দায়ী।
প্রতিদিন কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করা প্রত্যেকের জন্য জরুরি। একসঙ্গে বেশি পরিমাণ পানি পান না করে ইফতার ও সাহরির মধ্যবর্তী সময়ে অল্প অল্প করে বারবার পানি পান করা ভালো।
কী খাবেন, কী বাদ দেবেন
যেসব খাবার খাবেন : শস্যজাতীয় খাবার হলো লাল চাল, লাল আটা, বার্লি, ওটস, সেমাই ও সাগুদানা। আমিষ জাতীয় খাবারের মধ্যে মাছ, মুরগির মাংস, মটরশুঁটি, শিমের বিচি ও ডিম (কুসুমসহ খেলে সপ্তাহে তিনটির বেশি নয়)। দুধ ও দুধজাতীয় খাবার যেমন ননিবিহীন দুধ, দই, লাবাং ও ফ্যাটযুক্ত চিজ। এ ছাড়া সব ধরনের তাজা শাকসবজি, ফল ও চিনিবিহীন ফলের জুস।
ইফতারিতে খাওয়া যাবে : খেজুর যাতে চিনি, খাদ্যআঁশ, শর্করা, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের ভালো উৎস। হালিম একদিকে আমিষের ঘাটতি পূরণ করবে, অন্যদিকে দীর্ঘক্ষণ পেটে থাকবে। আমন্ড আমিষসমৃদ্ধ খাবার। কলায় শর্করার সঙ্গে সঙ্গে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম পাবেন।
বাদ দেবেন : সাদা চাল, সাদা আটা, সাদা পাউরুটি ও ফ্রায়েড চিকেন, চর্বিযুক্ত মাংস, খাসির মাংস ও কলিজা। পূর্ণ ননিযুক্ত দুধ, আইসক্রিম, মিষ্টি, ছানা, নারকেল, সবজি ভাজা ও চিনিযুক্ত ফলের রস।
ক্ষতিকর খাবার : অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, ভাজা ও ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার, সাহরির সময় অতিরিক্ত চা, অধিক লবণসমৃদ্ধ খাবার।
খাবারে সতর্কতা
রোজায় খাদ্য তালিকায় ডাইজেস্টিং খাবার বেশি রাখা উচিত। যেখানে ডাইজেস্টিং খাবার ডাইজেস্ট হতে প্রায় ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে দ্রুত ডাইজেস্টিং খাবার মাত্র ২ থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যে ডাইজেস্ট হয়ে যায়। আঁশ বা ফাইবার প্রধান খাবারগুলোই সাধারণত ডাইজেস্টিং খাবার। যেমন ঢেঁকিছাঁটা চাল, আটা, মটরশুঁটি, ছোলা, ডাঁটাশাক, পালংশাক। খোসাসহ ফলের মধ্যে পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি এবং শুকনা ফল খোরমা, খেজুর ইত্যাদি; তবে খাবার অবশ্যই সুষম হতে হবে। খাদ্যতালিকায় দানাদার খাবারের সঙ্গে পরিমাণ মতো ফল, শাকসবজি, মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার থাকা দরকার।
গরমের সময় রোজা রাখা কষ্টকর। ঠিকমতো পানি পানি না করলে পানিশূন্যতা তৈরি হয় এবং হজমেও সমস্যা হয়। তাই রোজা ভাঙার পর দেহে পানির চাহিদা মেটাতে বেশি করে পানি পান করতে হবে। কোমল পানীয় বাদ দিয়ে ডাবের পানি পান করতে পারেন। ডাবের পানিতে রয়েছে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্লোরিন ইত্যাদি । ডাবের পানির সঙ্গে লবণের অভাব পূরণ করতে খাবার স্যালাইনও পান করা যায়। সারা দিন রোজা রাখার ফলে হজমশক্তি এমনিতেই দুর্বল থাকে। এ সময় তেলেভাজা খাবার বেশি খেলে বদহজম ও অ্যাসিডিটি হতে পারে। তাই বাইরের খাবার বাদ দিয়ে ঘরে বানানো খাবার খেতে পারেন। আঁশযুক্ত খাবার পেটে থাকে অনেকক্ষণ, হজম হতে দেরি হয়। তাই ক্ষুধা লাগে কম। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখতেও সাহায্য করে। সাহরির সময় আঁশজাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। তাছাড়া রমজানে অনেকেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় পড়েন। তাদের জন্য আঁশযুক্ত খাবার খুব দরকার। বেশি করে পানি পান, মাঝে মাঝে ইসবগুলের ভুষি খেতে পারেন।
ইফতারির সময় অতিরিক্ত খেয়ে ফেলবেন না। সময় নিয়ে অল্প করে খেতে হবে। সারা দিন খালি পেটে থাকার পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম থাকে। ইফতারির সময় দ্রুত খাবার খেতে থাকলে হঠাৎ করে অতিরিক্ত খাবারের কারণে রক্তে নিঃসৃত ইনসুলিনের প্রভাবে রক্তে থাকা অবশিষ্ট গ্লুকোজও শেষ হয়ে যায়। ফলে খুব বেশি ক্লান্তিবোধ করতে পারেন। ইফতারিতে মিষ্টিজাতীয় খাবার খুব দ্রুত শরীরে শক্তি জোগায়। খেজুরে থাকা গ্লুকোজ খুব দ্রুত শরীরে শোষিত হয়। অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় খাবার যেমন জিলাপি খুব কম সময়ের মধ্যে শক্তি দেয়।
ইফতারিতে বেশি করে ফল খেতে পারেন। ফল খেলে শরীরের ভিটামিন, শক্তি, খনিজ পদার্থ ফাইবার ইত্যাদির জোগান দেয়। পেঁপে, কলা, আম যে ফলই খান না কেন সবই কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করবে। তাই ইফতারিতে চেষ্টা করুন সাধ্যমতো ফল খেতে। ইফতারির পর অনেকেই দই-চিঁড়া খেয়ে থাকেন। পেট রাখে ঠা-া, দ্রুত সহজে হজম হয়। চিঁড়ায় রয়েছে অ্যাসিডিটি কমানোর ক্ষমতা, দই খুব সহজেই পরিপাক হয়। হালিম খুব ভালো খাবার, যা আমিষের চাহিদা মেটায়। তবে নানা ধরনের ডাল দিয়ে রান্না হয় এবং মসলার ব্যবহার বেশি থাকায় হজমে সমস্যা করতে পারে। সুতরাং বুঝেশুনে খেতে পারেন। অধিকাংশ মানুষই ইফতারিতে ছোলা-মুড়ি খেতে পছন্দ করেন। তবে ছোলায় বেশি মসলা না থাকাই ভালো। মুড়ি বুকজ্বালা এবং অ্যাসিডিটি কমায়। ইফতারে খেজুর, ঘরের তৈরি বিশুদ্ধ শরবত, কচি শসা, পেঁয়াজু, বুট, মৌসুমি ফল থাকা ভালো। রাতের খাবারে পরিমাণমতো ভাত, মাছ বা মুরগির মাংস, ডাল ও সবজি খেতে পারেন। সাহরির খাবার মুখরোচক, সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া প্রয়োজন। বেশি তেল, বেশি ঝাল, বেশি চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। ভাতের সঙ্গে মিশ্র সবজি, মাছ-মাংস অথবা ডিম ও ডাল থাকা প্রয়োজন। পাকস্থলীতে বেশি উত্তেজনা কিংবা অস্বস্তি সৃষ্টি করে এমন খাবার খাওয়া ঠিক নয়। কারণ গুরুপাক খাবার খেলে শরীরের বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায়। যারা অতিরিক্ত ওজনের সমস্যা ভোগেন তারা রমজান মাসে রোজা রেখে ওজন কমাতে পারেন।
রমজানের খাদ্যতালিকায় থাকবে মোট খাবারের তিন ভাগের এক ভাগ ফলমূল ও শাকসবজি। বাকি তিন ভাগের এক ভাগে রাখুন ভাত, রুটি, পাউরুটি, আলুর মতো কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার। এর সঙ্গে প্রোটিন হিসেবে রাখুন মাছ, মাংস, অল্প চর্বিযুক্ত খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার। কার্বোহাইড্রেট খাবার বাছাইয়ের সময় জটিল ধরনের কার্বোহাইড্রেট রাখলে সারা দিন শরীরে শক্তি পাওয়া যায়। জটিল কার্বোহাইড্রেট ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি উৎপাদন করে। ঢেঁকিছাঁটা চাল, বাসমতী চাল, ওটস, লাল আটা জটিল কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার। আঁশযুক্ত খাবারও ধীরে ধীরে হজম হয় এবং দীর্ঘ সময় শক্তি সরবরাহ করতে পারে; যেমন ছোলাবুট, শিমের বীজ, খোসাসহ আলু, শাকসবজি এবং এছাড়া সব ধরনের ফলই আঁশযুক্ত।
তবে রোজার সময় বেশ কিছু খাবার খাওয়া একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। যেমন বেশি ভাজা খাবার (পেঁয়াজু, বেগুনি, পাকোড়া, শিঙাড়া, সমুচা ইত্যাদি), ভুনা মাংস বা মাংসের ফ্রাই, বেশি তেলযুক্ত বা বেশি তেলে রান্না করা খাবার, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার (পেস্ট্রি), উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত খাবার, বেশি মসলাযুক্ত খাবার, রিফাইনড সুগারসমৃদ্ধ খাবার বা প্রসেস করা খাবার ও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা, কফি, কোলা)। সাহরিতে খাবার খুব বেশি খেয়ে ফেলবেন না। সারা দিন শক্তি পাওয়ার জন্য বরং এই বেলার খাবারে জটিল কার্বোহাইড্রেট ও আঁশযুক্ত খাবার রাখুন।
মডেল : সারাহ তাসনিম প্রাপ্তি, খাদিজা খানম, তোহিদুল ইসলাম
আলোকচিত্র : আবুল কালাম আজাদ
সূত্র: দেশরূপান্তর
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.