ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
করোনায় আক্রান্ত ৬৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তির অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিক্যাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে তার মেয়েকে। অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেও ভাড়ায় নেওয়া যায়নি অক্সিজেনের সিলিন্ডার। সবাই সিলিন্ডার ভাড়া না দিয়ে বিক্রি করতে চায়, দামও চাইছে আকাশচুম্বী। বাধ্য হয়ে তিনি একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ফুল সেট কেনেন ৪২ হাজার টাকায়। এর সঙ্গে আছে ট্রলি, ফ্লো মিটার, ক্যানোলা এবং মাস্ক।
শুধু তিনি নন, বেশ কিছুদিন ধরে যারাই অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনছেন চওড়া মূল্য গুনতে হচ্ছে তাদের। ঢাকার বিভিন্ন অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম বেড়েছে জীবন বাঁচানো এই মেডিক্যাল গ্যাস সিলিন্ডারের। করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে এর দাম ১০-১২ হাজার টাকা এবং তারও আগে ৫-৬ হাজার টাকার মধ্যে থাকলেও সম্প্রতি তা এক লাফে বেড়ে ২০-২২ হাজার হয়ে যায়। গত জুন মাসের ১ তারিখ থেকে বাজারে সিলিন্ডার সংকট দেখা দেওয়ায় এর দাম আরও বাড়তে বাড়তে এখন ৪৭ হাজার টাকায় এসে ঠেকেছে। এমনকি ১ হাজার ৪০০ লিটারের (১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার) অক্সিজেন সিলিন্ডার ৪৭ হাজার টাকা মূল্যেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, করোনায় অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সিলিন্ডার সংকটে পড়েছেন তারা। কেউ কেউ শুধু খালি সিলিন্ডার বিক্রয় করছে ২০-২৫ হাজার টাকায়। তারা আরও জানান, অনেকেই আগাম সতর্কতা হিসেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘরে তুলে রাখছেন। যে কারণে সিলিন্ডারের সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া অক্সিজেন উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অক্সিজেনের উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও সিলিন্ডারের অভাবে সরবরাহে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।
বাজারে কয়েক ধরনের সিলিন্ডার থাকলেও ‘লিনডে’, ‘চায়না’ এবং ‘প্রাইভেট’ —এই তিন ধরনের সিলিন্ডারের চাহিদা বেশি বলে জানা গেছে। মেডিক্যাল গ্যাসের চাহিদার দিক থেকে লিনডের চাহিদা বেশি। কিন্তু তেজগাঁওয়ে অবস্থিত এই কোম্পানির সিলিন্ডার বাইরে বিক্রি হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত দামে। লিনডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, সিলিন্ডারের প্রচণ্ড ক্রাইসিস। গ্যাস উৎপাদন পর্যাপ্ত আছে। আমাদের সিলিন্ডারগুলো বাইরে কেমন দামে বিক্রি হচ্ছে সেটা জানা নেই, তবে আমরা দাম বাড়াইনি। আমাদের কাছে সিলিন্ডার আসা মাত্রই আমরা সেটা রিফিল করে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানান, ১ হাজার ৪০০ লিটারের (১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার) অক্সিজেন সিলিন্ডারের সেট ভ্যাট-ট্যাক্সসহ প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে স্টকে কোনও সিলিন্ডার নেই। উৎপাদনকারীরা বলছেন, অক্সিজেন উৎপাদনে আগে যে খরচ হতো এখনও তা একই রয়েছে। প্রতি ঘনমিটার অক্সিজেন হাসপাতালে দেওয়া হয় ৪৫ টাকা দামে। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করা হয় প্রতি ঘনমিটার ৩৫ টাকায়।
গুলশানের কালাচাদপুরের মাইশা কেয়ারের বিক্রয় প্রতিনিধির কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম জানতে চাইলে তিনি জানান, লিনডের গ্যাস সিলিন্ডারের দাম পড়বে ৪০ হাজার ২০০ টাকা এবং চায়না গ্যাস সিলিন্ডারের দাম পড়বে ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। এগুলোর ধারণ ক্ষমতা ২ হাজার লিটার (২ কিউবিক মিটার)। এই মূল্য সিলিন্ডারের ফুল সেটাপসহ তবে মাস্ক ছাড়া। তিনি জানান, দাম আরও বাড়বে। আমরা অনেক অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছি। কারণ সিলিন্ডার অর্ডার করা আছে কিন্তু আমরা পাচ্ছি না বাজারে। এখন যে রেটে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ১০ দিন আগেও এই রেটে দুটি সিলিন্ডার বিক্রি হতো। আমরা সিলিন্ডার ভাড়াতেও দিতাম, কিন্তু সিলিন্ডারের অভাবে এখন তাও পারছি না।
জাকির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন জানান, এই মুহূর্তে তার কাছে কোনও সিলিন্ডার নেই। হয়তো দুদিন পরে আসবে। এলেও ১ হাজার ৪০০ লিটারের (১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার) সিলিন্ডার পড়বে ৪৫-৪৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে যা বিক্রি হয়েছে তার মধ্যে লিনডে বিক্রি হয়েছে ৪৭ হাজার টাকায় এবং ‘প্রাইভেট’ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে ৩৬ হাজার টাকায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন কিংবা সিলিন্ডারের কোনও সমস্যা নেই। গত ২৮ এপ্রিলের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল ও আইসোলেশন ইউনিটগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহে কোনও ঘাটতি নেই। সারা দেশে সব উপজেলায় ১০ হাজার ৩৯৪টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। প্রতি উপজেলায় প্রয়োজন অনুসারে অক্সিজেন সিলিন্ডার রেখে বাকিগুলো জেলা হাসপাতালে প্রেরণের জন্য বলা হয়েছে। কোভিড-১৯ উপলক্ষে আরও ৩ হাজার ৫০০ অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে যাতে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো পুনরায় রিফিল করা যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট নেই। ৮টি বিভাগে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতাল বাদে ১৩ হাজার ৭৪৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। এছাড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালের কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। তবে বাইরে সিলিন্ডারের অতিরিক্ত দামের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হাসপাতালে অক্সিজেনের সরবরাহে কিংবা সিলিন্ডারের ঘাটতি আছে কিনা জানতে চাইলে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জানান, আমরা দুইভাবে ম্যানেজ করছি। আমাদের হাসপাতালে সেন্ট্রাল সাপ্লাই আছে আর সিলিন্ডারের ব্যবস্থা আছে। আমরা বাংলাদেশ অক্সিজেন লিমিটেড থেকে অক্সিজেন নিয়ে থাকি। আমরা এখনও অক্সিজেনের ক্রাইসিস অনুভব করিনি, দামের ক্ষেত্রেও না। তবে বাইরে কিছু অসাধু লোক দ্বিগুণ-তিনগুণ করে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অক্সিজেন ব্যবহার করা বেশি ক্ষতিকর বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, মেডিক্যাল অক্সিজেন একটি রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় যেমনটি হলো ওষুধ। অন্যান্য ওষুধের মতো অক্সিজেন নিজে নিজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। আমরা করোনা রোগীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন ব্যবহার করি তিন ভাবে। একটি হচ্ছে, সিলিন্ডার, হাই ফ্লো এবং আরেকটি হচ্ছে রোগীর শ্বাসতন্ত্রে কৃত্রিম যন্ত্র দিয়ে ব্যবহার করি। রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে সেই মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে কী পরিমাণ অক্সিজেন দিতে হবে, তার একটি চিকিৎসাবিজ্ঞানীয় হিসাব আছে। এজন্য এটি নিজে নিজে কিনে ব্যবহারের যুক্তি নেই। অক্সিজেনের অযৌক্তিক এবং অতিরিক্ত ব্যবহারে চোখের লেন্সে ক্ষতি হয়, ফুসফুসের ক্ষতি হয়। তাই চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া কেউ যেন অক্সিজেনের সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার না করে। তা না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন/ভয়েস/আআ
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.