রাজেকুজ্জামান রতন:
যা হচ্ছে তা আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। আর ভবিষ্যতে কী হবে তা যেন আতঙ্কের শিহরণ বইয়ে দিচ্ছে সবার মনে। করোনা জীবনযাত্রার শুধু গতি কমিয়ে দিয়েছে তাই নয়, দুর্গতি বাড়িয়েছে সারা বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষের। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, আশঙ্কা বাড়ছে তীব্র বেকারত্বের। আমাদের দেশে প্রতি বছর ২২ থেকে ২৪ লাখ যুবক-যুবতী শ্রমবাজারে আসে কাজের আশায়। বেকারত্বের জ্বালা থেকে মুক্তি পেয়ে কাজ করে নিজে বাঁচবে, সংসারের হাল ধরবে আর দেশের উৎপাদনে ভূমিকা রাখবে বলে। এদের মধ্যে সরকারি হিসাবে দেড় লাখ কাজ পায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে, বেকারত্ব দূর করতে অথবা উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমায় ৮ লাখের বেশি আর বাকি ১২ থেকে ১৪ লাখ যুবক-যুবতী চেষ্টা করে দেশে কিছু একটা করে জীবন বাঁচাতে। জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে নেমে জীবন সাজানোর কথা ভুলেই যায় অনেকে। দেশের শ্রমশক্তির পরিমাণ ৬ কোটি ৩৫ লাখ (এটা লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৭ এর হিসাব)। এদের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। অর্থাৎ যাদের মাসিক বেতনের ঠিক নেই, দিন এনে দিন খাওয়ার মতো অবস্থা। এই করোনাকালে তাদের দুর্দশার শেষ নেই। যারা মাসিক বেতনে কাজ করে তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে গার্মেন্টস শিল্পে। এখানে কর্মরতদের ৬০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক। গ্রাম থেকে উঠে এসে রপ্তানিমুখী কারখানায় আধুনিক যন্ত্রের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে শহরের বস্তিতে থাকা এইসব নারী শ্রমিকরা রপ্তানি আয়ের ৮২-৮৪ শতাংশ আয়ের সঙ্গে যুক্ত। তাদের কখনো বোন, কখনো মেয়ের মতো বলে সম্বোধন করলেও তাদের ন্যায্যমজুরি ও চাকরির নিশ্চয়তার ব্যাপারে নীরব থেকেছেন বিশাল গার্মেন্টস সেক্টরের ততোধিক বিশাল মাপের মালিকরা।
বার্ষিক ১২ হাজার ডলারের রপ্তানি আয় দিয়ে যে তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৭৮ সালে, ২০১৯ সালে তারা রপ্তানি করেছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অর্থাৎ ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার পণ্য। কেউ ৩ লাখ বা কেউ ৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে যে মালিকরা ব্যবসা শুরু করেছিলেন তাদের অনেকেই আজ হাজার কোটি টাকার মালিক। এ ছাড়াও তারা বিশাল শিল্প, ব্যাংক, টেলিভিশন সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক। ৪০ বছর পর এখন কয়েকশ কোটিপতি, মন্ত্রী, মেয়র, এমপি আর ৪০ লাখ শ্রমিক রয়েছে এই খাতে। বিশ্বে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাকের বাজারে ৩৬ শতাংশ হিস্যা নিয়ে চীন, ৬ শতাংশের কিছু বেশি নিয়ে বাংলাদেশ, প্রায় ৬ শতাংশ নিয়ে জার্মানি, এর পরপরই ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্ক, স্পেন, পাকিস্তান, কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশ অবস্থান করছে।
তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক এবং সর্বনিম্ন মজুরির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত ধনী হওয়ার বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকরা হয়ে আছে কর্মজীবী দরিদ্র। কাজ তাদের দারিদ্র্য দশা থেকে মুক্তি দিতে পারছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে যখন তখন ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। এবারের করোনা দুর্যোগে সবার আগে সরকারি প্রণোদনা ৫ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে গার্মেন্টস মালিকরা যেন তারা এপ্রিল, মে ও জুন মাসে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে। মাত্র ২ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জে বরাদ্দ এই টাকা পেয়েও এপ্রিল থেকেই শুরু হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাই আর এর প্রতিক্রিয়ায় চলছে শ্রমিক অসন্তোষ আর বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভে ঘি ঢেলেছে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন, জুন মাস থেকে শ্রমিক ছাঁটাই করা হবে, এ কথা বলে। যে শ্রমিকের শ্রমে ঘামে এই বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে শ্রমিকদের সেখানে কোনো ঠাঁই নেই। অতীতের ভূমিকা থেকে ধারণা করা যায় যে ১০/১২ লাখ শ্রমিক কাজ হারাবে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তার কিছুটা বাস্তবতা থাকলেও এই দুর্যোগে শ্রমিকদের ছাঁটাই করার কথা বলে সরকারের কাছে নতুন কোনো সহায়তা প্রত্যাশা করছেন তারা। পাশাপাশি বায়ারদের সহানুভূতি, সহায়তা প্রত্যাশা করা এবং শ্রমিকদের ওপর কাজের বোঝা বাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরির জন্য তাদের প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে। কিন্তু এটা সত্য যে ছাঁটাই হলে তা শ্রমিক অসন্তোষের জন্ম দেবে।
অদ্ভুত সৌজন্যের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কেউ জিজ্ঞেস করে যদি বলেন, কেমন আছেন? শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ উত্তর হচ্ছে, ভালো। উত্তর যিনি দেন এবং যিনি শোনেন দুজনেই জানেন এটি যথার্থ উত্তর নয়। একটু সময় নিয়ে কথা বললে বেরিয়ে আসে চাপা দীর্ঘশ্বাস আর কষ্টের কথা। মানসিক চাপে থাকা মানুষদের চাপের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। আশা আর অগ্রগতির হিসাব মেলাতে না পারার ব্যর্থতা কুরে কুরে খাচ্ছে যাদের, তারাও মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলেন, এই চলে যাচ্ছে, আর কি! তাতে দিন প্রাকৃতিক নিয়মে চলে গেলেও সংকট তো সেভাবে যায় না। সংকট আরও ঘনীভূত হয় আর স্বপ্নগুলো পালিয়ে যেতে থাকে। একদল স্বপ্নহীন দিন যাপনকারী মানুষের মুখে ভালো আছি শুনে আর বিষণœ হাসি দেখে ভালো যে নেই সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কেমন আছে জিজ্ঞেস করার উত্তরে কী বলেছে সেই কথাটাকে সত্য বলে ধরে নিলে বাস্তবতা বুঝতে পারা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তেমনি যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাজেট কেমন হবে? তার উত্তরেও বেশির ভাগ মানুষ বলবেন, কী আর হবে? দেশের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক অগ্রগতির বিবরণ আর পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কার বাস্তবতা মিলবে না কোনো বিন্দুতেই। ‘ল অফ ডিমিনিশিং মারজিনাল ইউটিলিটি’র পরিবর্তে ‘লুজিং মারজিনাল ইকুইটি’ যেন বেদনাময় বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে দিন দিন। সমাজে সমতার পরিবর্তে অসমতার বিস্তৃতি ঘটছে স্বাধীনতার বয়স বৃদ্ধির চেয়েও দ্রুতগতিতে। ফলে মানুষের জীবনে ভাবনার চেয়ে দুর্ভাবনা বাড়ছে। বাজেট এই গতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এবারও কি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ দেখাতে গিয়ে মানুষের জীবন মানকে উপেক্ষা করা হবে?
বৈশ্বিক মহামারী করোনা বিশ্বের এমন কোনো প্রান্ত নেই যাকে স্পর্শ করেনি, এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে আঘাত করেনি। উন্নয়নের সূচক আর দৃষ্টান্তগুলোকে একেবারে ধসিয়ে দিয়েছে। দ্রুতগতির বুলেট ট্রেন, আকাশছোঁয়া স্কাই স্ক্র্যাপার, ফাইভ সিক্স সেভেন স্টার হোটেল, বহু লেন বিশিষ্ট ফ্লাইওভার, প্রশস্ত রাস্তা, চোখ ধাঁধানো শপিং মল, ঝাঁ চকচকে গাড়ি, ঘন ঘন পোশাকের ফ্যাশনের পরিবর্তন, ফাস্টফুড আর পানীয়ের এলাহি ব্যবস্থা না হলে উন্নতি বুঝব কীভাবে? উন্নয়নের এই ধারণাকে প্রচার করা হয়েছে এত যতেœ আর এত আকর্ষণীয়ভাবে যে মানুষ বঞ্চনা ভুলে চোখ বড় করে আর মুখ হা করে দেখে বলত, বাবা, কী উন্নতি করেছে দেখেছ? কোনো প্রতিষ্ঠানের কারও চাকরি চলে গেলে তার অযোগ্যতাকে দায়ী করার মানসিকতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল এমনভাবে যে চাকরি হারানো মানুষ লজ্জায় মুখ লুকাত আর বঞ্চনা ও বেদনাকে বুকে চেপে রাখত। নয়জন পেছনে পড়ে থাকা বিবেচনার বিষয় নয় একজন কত তরতর করে ওপরে উঠে গেছে, সেই সফল মানুষ সবার কাছে দৃষ্টান্ত আর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠত। শিব খের এর ‘তুমিও পারবে’ টাইপের বই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে বিক্রয়যোগ্য বইয়ের তালিকার শীর্ষে। করোনার ধাক্কায় এই সব ফানুসের মতো ফেটে গেল। করোনা সিস্টেম পাল্টায়নি বরং সিস্টেমের ফাঁকফোকরগুলো চোখের সামনে তুলে ধরল। ব্যক্তির সাফল্যের যে ধারণা পূজনীয় ছিল, সমাজের জন্য কাজ করার ভাবনাগুলো পরিত্যাজ্য করে ফেলা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে, তার অসারতা এবং ব্যক্তির অসহায়ত্ব প্রকট করে তুলল।
কৃষিকে তাচ্ছিল্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে বাণিজ্যিক ও বিদেশমুখী করে তোলা হয়েছিল। সরকারি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানে সাধারণ মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র। ভিআইপি এবং তাদের সন্তানদের জন্য বিদেশ বা নিদেনপক্ষে দামি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যা যতটা উন্নত তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞাপিত। যেখানে যাওয়াটা ব্যয়বহুল এবং সামাজিক মর্যাদাবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছিল। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এদের মুখোশ খুলে মুনাফালোভী মুখটা দেখিয়ে দিল।
করোনাকালে প্রণীত হচ্ছে এবারের বাজেট। জনগণের বেঁচে থাকার এই যুদ্ধে বাজেট যেন সহায়তা করে তেমন করে প্রণয়ন করতে হবে। কৃষিতে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ আর স্বাস্থ্য খাতে ৫ শতাংশ বাজেট নিয়ে আর যাই হোক করোনা দুর্যোগ ও পরবর্তী সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। করোনার সঙ্গে সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে বেকারত্ব ও অনাহার তা যেন বাজেট প্রণয়নের সময় খেয়াল রাখা হয়। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, দরিদ্র জনগণের সুরক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রবাসী পুনর্বাসন, ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে বাজেটে। দূরের বাদ্যে কান না দিয়ে ঘরের কান্না দূর করার এবং ব্যবসাবান্ধব নয় মানুষ বাঁচানোর বাজেট দেখতে চাই। মেগা প্রজেক্ট একবছর দেরি হলে সেটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে কিন্তু মহামারীর সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং মানুষকে বাঁচানো না গেলে সব কিছুই অসার হয়ে পড়বে।
লেখক-
রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট
rratan.spb@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.