আবদুল বায়েস:
এ পর্যন্ত যত বাজেট বাংলাদেশ পেয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বাজেট আজ পেশ হতে যাচ্ছে। এক অর্থে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। কারণ উত্তাল সাগরে জাহাজ চালানোর সুযোগ তিনি পেলেন। সবাই শান্ত নদীতে সাঁতার কাটতে পছন্দ করে এবং এতে কৃতিত্ব আছে বলে মনে হয় না। মরহুম জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদও খুব কঠিন সময়ে বাজেট পেশ করেছিলেন, তবে তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি বিধ্বস্ত থাকলেও বিশ্ব অর্থনীতি অতটা টালমাটাল ছিল না যেমনটি এই মুহূর্তে। একটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পৃথিবী সামনে রেখে বাংলাদেশের বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস যখন সারা পৃথিবীকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারে ঠেলে দিচ্ছে, এমনকি ধনী দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে, সেখানে বাংলাদেশের নাভিশ্বাস ওঠা অস্বাভাবিক নয়। দুঃখ একটাই, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নির্দেশকে বাংলাদেশ যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, করোনার প্রভাবে তা শুধু থমকে যায়নি, দারিদ্র্য বাড়ছে, মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে, সরকারি কোষাগারে চাপ বাড়ছে। রাজস্ব আয়ের চেয়ে ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাস থেকে প্রাপ্ত শাস্তি সম্পর্কিত কমবেশি ধারণা সবার মধ্যে আছে—বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মৃত্যু। প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী; প্রক্ষেপিত হারের প্রায় অর্ধেক বা তার কিছুটা নিচে থাকবে বলে অনুমান। চারদিকে চরম আতঙ্ক। সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন সমাজে অস্থিরতা, অচলাবস্থার জন্ম দিয়ে চলেছে। অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি থেকে এর পার্থক্য এই যে কভিড-১৯ অচেনা এক শত্রু, যা মানুষ থেকে মানুষে, সমাজ থেকে সমাজে এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশে আক্রমণ চালায়। মোট কথা, এক শ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লুর পর কভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী এক মহা আতঙ্কের নাম।
করোনাকালে প্রকৃতির ওপর চাপ খুব কম থাকে বিধায় পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। বায়ু ও শব্দদূষণ কম। নীল আকাশ, পাখির কিচিরমিচির ডাকে মানুষ সুস্থ থাকে।
তবে সব দেশের জন্য করোনা শিক্ষণীয় কিছু না কিছু দুর্বলতা ও শক্তিময়তা উন্মোচন করেছে, যার দাম একেবারে কম নয়। পৃথিবীর সব দেশ করোনা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে, আমরা না হয় আপাতত বাংলাদেশ নিয়ে থাকি।
প্রথম শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য সেবা খাতের চরম বিপর্যয় ও অপারগতা। এ যেন কাঠের মাচার ওপর নির্মিত বহুতলবিশিষ্ট দালান—তা-ও সেগুন কাঠ নয়। করোনা না এলে কস্মিনকালেও বুঝতাম না এর করুণ কাহিনি। টেস্ট, ট্রেস আর ট্রিটমেন্টে কৃতিত্ব ভালো নয়। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক্তার, নার্সদের সেবা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দুই. এখনো গ্রাম তথা কৃষিই ভরসা। যদিও শহুরে ও কেতাবি অর্থনীতিবিদদের কাছে কৃষির ভূমিকা অস্তায়মান সূর্যের মতো। একমাত্র খাদ্য খাত এখনো খাদে পড়েনি। এমনকি গ্রামীণ সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবহন করোনাকালে ততটা পরাজিত নয় যতটা পণ্ডিতরা ভাবছেন বা ভেবেছেন।
এই দুই কারণে খাত দুটোতে ব্যাপক বরাদ্দ বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিন. ১২ বছর ক্ষমতায় থেকেও সরকারি দল বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ে সংকট মোকাবেলায় তেমন সংগঠিত নয় বলে মনে হয়েছে। কোথাও কোথাও ত্রাণ বিতরণে অব্যবস্থা দলীয় দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর সততা, আন্তরিকতা, খাটুনি ও অবদান সূর্যালোকের মতো দৃশ্যমান। সমন্বয়হীনতার অভাব, আমলাদের অদক্ষতা, তথ্য ও উপাত্তভিত্তিক কৌশলগত আচরণে ঘাটতি সরকারের সদিচ্ছাকে সমালোচকের খোরাক করেছে।
চার. শক্তিশালী সহনীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যে কত জরুরি দরকার তা প্রতি মুহূর্তে করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
করোনাকালে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরাট ধাক্কা অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি আরো শক্তিশালী করার তাগিদ দেয়। আগামী পৃথিবী হতে চলছে অপেক্ষাকৃত অধিক সংরক্ষণবাদী। সুতরাং দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশে দাঁড়াতে হবে। এমনকি প্রণোদনা প্যাকেজে এদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়াতে হবে।
আশা করি, এবারের বাজেট হবে মানুষ বাঁচানোর বাজেট। ‘অস্টারিটি’ শব্দটা সাতের দশকে শুনতাম; এখন আবার শুনতে চাই। অপব্যয়, অপচয়, কথায় কথায় বিদেশ ভ্রমণ কমাতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত স্বাস্থ্য খাতে, তারপর কৃষি। নতুন বড় বড় প্রকল্পের দরকার আছে বলে মনে করি না, ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনায় প্রকল্পের প্রশ্নই ওঠে না। বাজেট ঘাটতি মোকাবেলায় দেশি উৎসর চেয়ে বিদেশি উৎসর অর্থ যথাযথ হবে বলে ধারণা। বাজেট ঘাটতি শতকরা ৫ ভাগের বেশি হলে ভাবনার কিছু নেই, যেমন নেই সামান্য টাকা ছাপালে।
সংকটে পড়লে সরকার ভাবে, এবার রক্ষা পেলে সব কিছু ঠিক করা হবে। সংকট কেটে যাওয়ার পর আগের কথা আর মনে থাকে না। উদাহরণ বেড়িবাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার ইত্যাদি।
আমরা প্রতিবছর একই জায়গায় গাছ লাগিয়ে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।ইতিহাসের বড় শিক্ষা এই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। আশা করি, করোনা চরম শিক্ষা দিয়ে ইতিহাসের শিক্ষা আমলে নিতে বাধ্য করবে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.