রাজেকুজ্জামান রতন:
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি না থাকলেও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। ফলে খেটে খাওয়া মানুষসহ দুর্নীতির সুযোগহীন সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস, উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি সত্ত্বেও কর্মহীন ও কর্মপ্রত্যাশী মানুষের দুর্বিষহ জীবন, করোনার আঘাত ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বাজেট ২০২২-২৩ আসছে। আগামী ৯ জুন সংসদে বাজেট উত্থাপন করা হবে। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে প্রচুর প্রশংসাসূচক আলোচনা হবে বাজেট নিয়ে। দু-একজন বাজেট নিয়ে প্রতিবাদ করবেন এবং শেষ পর্যন্ত যা বলা হবে বাজেট বক্তৃতায় সেটাই সংসদে পাস হয়ে যাবে।
বাজেটকে যদি এক বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলা হয় তাহলে তা নিয়ে সমালোচনা তো হবেই। জবাবদিহিও থাকতে হবে। আয় করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে, কোন খাতে কত বরাদ্দ, কেন বরাদ্দ আর এক বছরে তার কতটুকু ব্যয় করা সম্ভব হলো এবং তার ফলে সাফল্য কতটুকু অর্জিত হলো তা নিয়ে বিশ্লেষণ না হলে গত অর্থবছর থেকে শিক্ষা নেওয়া হবে না। গত বাজেট পাস করার সময় যারা প্রশংসার বন্যায় অর্থমন্ত্রীকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন এবারও তারা কথার ফুলঝুরি ছড়াবেন কি না সে বিষয়েও তো বিবেচনার অবকাশ থাকে। কিন্তু সমালোচনা গ্রহণের মানসিকতা না থাকলে, অর্থনীতি নিয়ে যারা ভাবেন তারা সরকারের পছন্দমতো কথা না বললে তাদের অপমান বা তাচ্ছিল্য করলে হয়তো রাজনৈতিক সান্ত্বনা পাওয়া যায় কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট দূর করা যায় না।
বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক করার অংশ হিসেবে সমাজের নানা অংশের মানুষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার কথা বলা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ব্যবসায়ী মহল এবং পছন্দসই ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়। দেশের প্রধান খাত কৃষি, কিন্তু কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজনই বোধ করে না, ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমশক্তি, কিন্তু শ্রমিক প্রতিনিধিদের কথা শোনা হয় না, ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী কিন্তু তাদের সমস্যা বা প্রয়োজন নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মহল যেমন ছাত্র প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস পর্যন্ত করা হয় না। বলা হয় কৃষকবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব এবং শিক্ষানুরাগী সরকার কিন্তু কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র কোনো স্তরের প্রতিনিধিরাই বাজেট প্রণয়নের পূর্বে মতামত দেওয়ার সুযোগ পান না। শুধু বিভিন্ন ধরনের আর বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই বাজেট প্রণয়নের পূর্বে আলোচনার অধিকার পান। যেমন কাজ তার ফলাফলটাও তেমনি হয়। বাজেট প্রণয়ন করে সরকার, সুবিধা পায় ব্যবসায়ী মহল, দায় বহন করে সারা দেশের জনগণ।
স্বাধীনতার পর দেশের জিডিপি বেড়েছে ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪১১ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ৬৮ গুণ বেশি। মানুষের মাথাপিছু আয় ১২৯ ডলার থেকে ২৮২৪ ডলার হয়েছে। অর্থাৎ আয় বেড়েছে প্রায় ২২ গুণ। বাজেট বেড়েছে ৭৮৬ কোটি টাকা থেকে এবারের সম্ভাব্য বাজেট ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট বাড়বে ৮৫২ গুণ। এসব হিসাব সবই উন্নতির সূচক এবং অগ্রগতির দিকনির্দেশ করে। কিন্তু জিডিপি বৃদ্ধিতে কার অবদান কত এবং প্রাপ্তি কত, মাথাপিছু আয় কারা বাড়াল এবং কাদেরকে পেছনে ফেলে কারা সেই আয় পকেটে পুরল, বাজেট যত গুণ আকারে বাড়ল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি খাতে সে অনুযায়ী কতটুকু বরাদ্দ বাড়ল তা দেখলে আশাবাদের বিপরীতে বেদনা ও বিক্ষোভ জমে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছরই বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলেও আনুপাতিক হারে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ দিন দিন কমছেই। বলা হয়ে থাকে কৃষি হচ্ছে বর্তমানের নিরাপত্তা আর শিক্ষা ও চিকিৎসা হচ্ছে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা। কোনো দেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নকে যদি স্থায়ী রূপ দিতে হয় তাহলে কৃষিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো দরকার। আর ভবিষ্যতের মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষা আর আধুনিক চিকিৎসার কোনো বিকল্প নেই।
দেশের অর্থনীতিতে জিডিপির ১৪ শতাংশ হলেও কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশ অবদান কৃষি খাতের। খাদ্য নিরাপত্তা যেকোনো দেশের প্রধান উদ্বেগের বিষয়। সে কারণেই কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। করোনায় বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছিল যে কয়েকটি খাত তার মধ্যে কৃষি অন্যতম। এ কথা সব মহল থেকে বলা হলেও গত বাজেটে তার প্রতিফলন ছিল না। ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৫.৩৯ শতাংশ, আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৫.৩ শতাংশ। অর্থাৎ অনেক কথা বলেও বাজেটে বরাদ্দ কমানো হয়েছিল। কৃষি খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করা হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরেও একই পরিমাণ ভর্তুকি রাখা হয়েছিল। বাজেট বড় হলেও ভর্তুকির আকার বড় হয়নি। যার প্রভাব পড়েছে খাদ্য উৎপাদনে।
শিক্ষা খাতে যা বরাদ্দ হয় তার মধ্যে আবার রয়েছে নানা ধরনের ফাঁকফোকর। শিক্ষা খাতের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ খাত যুক্ত করে বরাদ্দের পরিমাণ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ২২ শতাংশ। ৫০ বছর পর ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আয়তন বেড়ে প্রায় ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা হলেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র ১১.৯ ভাগ। বাজেটের আয়তন বাড়ছে আর আনুপাতিক হারে প্রতি বছরই কমছে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল বাজেটের ১৫.২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ছিল বাজেটের ১১.৬৯ শতাংশ ও মোট জিডিপির ২.০৯ ভাগ। স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষা খাতে বাজেটের ২৫ শতাংশ ও জাতীয় আয়ের ৮ ভাগ বরাদ্দের যে দাবি ছাত্রসমাজ উত্থাপন করে চলেছে, তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে। শুধু বাজেটে নয় জিডিপির অনুপাতেও ২.২ এর ওপরে ওঠেনি কখনো শিক্ষা খাতের বরাদ্দ। আফগানিস্তান বাদ দিলে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণের দিক দিয়ে সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
করোনা মহামারী সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে শিক্ষাব্যবস্থায়। করোনাকালে দুটি বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু এই বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানী থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষাকার্যক্রম রক্ষা ও শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যে বিশেষ মনোযোগ ও বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল, তা গত দুটি বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে এবং ১৬ শতাংশ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারবে না। করোনার আঘাত আর অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার উদ্যোগ শিক্ষা ক্ষেত্রে শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব বৈষম্য আরও প্রকট করেছে। বাজেটে এই বৈষম্য দূর করা ও করোনায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ থাকবে কি না তা অনিশ্চিত।
দেশে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র। কিন্তু এসবের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। আবার বরাদ্দের একটা বড় অংশই ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বাজেটের ১ শতাংশেরও কম বরাদ্দ। এই বরাদ্দ দিয়ে কি উন্নয়ন হবে গবেষণার? অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির কথা বলে বিভিন্ন ধরনের ফি-এর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। ফলে ক্রমাগত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তার চরিত্র হারিয়ে প্রাইভেট তথা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে, আর জনগণের টাকায় পরিচালিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সন্তানের জন্য।
এই চিত্র শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক সব পর্যায়েই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যে উপবৃত্তি প্রদান করা হয় মুদ্রাস্ফীতির কারণে বরাদ্দকৃত মাথাপিছু বৃত্তির পরিমাণ চলমান বাজারদরের সাপেক্ষে বাড়ানো দরকার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোতে ক্লাসরুম-পরীক্ষার হল, শিক্ষক সংকট প্রকট, এই সংকট দূর করার কি পদক্ষেপ থাকবে তা অনিশ্চিত। করোনা দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা আর দুর্নীতি। এত আলোচনার পরও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৫ শতাংশের বেশি হচ্ছেই না। দুর্নীতি কমছে না বরাদ্দও বাড়ছে না। দ্বিমুখী সংকটে স্বাস্থ্য খাত। এবারে কি তার ব্যতিক্রম হবে?
বাজেট তো হবে, টাকা আসবে কোথা থেকে? কে আর দেবে? দেবে জনগণ। পাকিস্তান পর্বে ২ জন এবং স্বাধীনতার পর ৫ জন কোটিপতি নিয়ে যে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু সে দেশে এখন কোটিপতি দেড় লাখের বেশি। করোনার বিপর্যস্ত সময়কালেও বাংলাদেশে কোটিপতি বেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই ১৭ হাজার ২৯৩ জন। কিন্তু তাদের কতজন আয়কর দেন? বাংলাদেশে যে কয়েকশ ধনকুবের পয়দা হয়েছেন, তাদের কতজন এক কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন? ‘হাকিম জর্দার’ মালিক বছরের পর বছর এ দেশের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী হচ্ছেন, কিন্তু ওয়েলথ-এক্সের গবেষণায় যে ২৫৫ জন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর (কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫৫ কোটি টাকার মালিক) নাম উঠে এসেছে, তাদের নাম তো সর্বোচ্চ করদাতার তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
সাধারণ জনগণের ওপর ভ্যাটের বোঝা না চাপিয়ে সরকারি রাজস্বের প্রধান সূত্র হিসেবে আয়করকে প্রতিষ্ঠা করার দাবি বারবার উপেক্ষিত। এবারের বাজেটেও সে পথে হাঁটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ভ্যাটের আওতা বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ছিল ভোট এবং ভ্যাট দেওয়ার মালিক। সাধারণ জনগণের ভোট দেওয়ার দায়িত্ব এখন প্রায় নেই আর বাজেটে ভ্যাট দেওয়ার দায়িত্ব বাড়বে এটা নিশ্চিত।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট rratan.spb@gmail.com
উপদেষ্টা সম্পাদক : আবু তাহের
প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক : আবদুল আজিজ
সম্পাদক: বিশ্বজিত সেন
অফিস: কক্সবাজার প্রেসক্লাব ভবন (৩য় তলা), শহীদ সরণি (সার্কিট হাউজ রোড), কক্সবাজার।
ফোন: ০১৮১৮-৭৬৬৮৫৫, ০১৫৫৮-৫৭৮৫২৩ ইমেইল : news.coxsbazarvoice@gmail.com
Copyright © 2025 Coxsbazar Voice. All rights reserved.